সবাই একমত যে রাজশাহী দেশের সেরা শহর। পদ্মাপাড়ের এই পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন শহরটিকে দেশের সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরও বলা হয়। এমনকি সেই সেরা শহরটিও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। বৃষ্টির পরিমাণ একটু বেশি হলেও সুন্দর নগরী ডুবে যাওয়া নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই এই ডুবে যাওয়ার কারণ খুঁজছেন।
রাজশাহীতে গত বুধবার (৪ অক্টোবর) রাত সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয় বৃষ্টি। পরদিন বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়। স্থানীয় আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এই সময়ের মধ্যে ২৪৬ .৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। গত ১১ বছরে ২০ ঘণ্টায় এত বৃষ্টি হয়নি। এ বছর টানা বৃষ্টির কারণে বৃহস্পতিবার নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজশাহীর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যা নাগাদ প্রধান সড়কগুলো থেকে পানি নেমে গেছে। তবে শুক্রবার সকালে নগরীর কয়েকটি নিচু এলাকায় বৃষ্টির পানি জমেছে। গতকাল নগরীর বর্ণালী মোড় এলাকায় সড়কে নৌকা চলাচল করে। আজ সকালে দেখা গেছে, সড়কে পানি কমলেও পুরোপুরি কমেনি। অল্প বৃষ্টিতেই এই জায়গায় জল জমে থাকে। নগরীর নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল এলাকা, সিলিন্দা, তেরখাদিয়া কলেজপাড়া ও দাসপুকুর মহল্লার সরু গলিতে পানি জমে গেছে। অনেক বাড়ি থেকে এখনো পানি বেরোয়নি। দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বাসিন্দাদের।
বিশেষজ্ঞরা এই বন্যার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে বছরের পর বছর আবর্জনা ও পলিথিনে ভরা ড্রেন পরিষ্কার না করা, পুকুরের মতো জলাশয় ভরাট, অপরিকল্পিতভাবে ড্রেন নির্মাণ, রাস্তা ও ভবন নির্মাণ এবং সড়ক পুনর্নির্মাণ বা সংস্কারের সময় উচ্চতা ও ঢাল বিবেচনা না করে ক্রমাগত উন্নীতকরণ এই জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী। এটা বিশ্বাস করা হয়
আজ তেরখাদিয়া স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশে তরিকুল ইসলামের বাড়ির ভেতরে পানি জমে থাকতে দেখা যায়। তরিকুল ইসলাম বলেন, রান্নাঘর ডুবে গেছে। ঘরের ভিতরে জল। বাড়িতে রান্না নেই। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে বিছানায় বসে আছে তার স্ত্রী। বাইরে থেকে খাবার কিনে খাচ্ছে। পানি কমতে আরো সময় লাগতে পারে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার নগরজুড়ে পানি জমে থাকার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি দৈনিক পত্রিকাকে বলেন, “সড়কের ওপর নির্মাণসামগ্রী পড়ে থাকায় স্বাভাবিকভাবে ড্রেনে পানি নামতে পারছে না। এ ছাড়া পদ্মা নদীর সঙ্গে যুক্ত বড় ড্রেনের স্লুইস গেটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নগরীর বর্জ্য পানি নদীতে প্রবাহিত হয় না, ফলে ওই পাশ থেকে বাড়তি বৃষ্টির পানি নামতে পারে না।এছাড়া আটটি বড় ড্রেন যে খালে মিলিত হয়, সেখানে পাট উঠে যায়। শহরের উত্তরে বরান নদী পড়েছে।এর ফলে পানির স্বাভাবিক গতি কমে গেছে এবং বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু রসিক প্রকৌশলীর এই তিন ব্যাখ্যার যৌক্তিকতা পাচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরা। রাজশাহীর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সিটিজেন ফর গুড গভর্নেন্স (সুজন) এর জেলা সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, ‘আদি রাজশাহীতে পদ্মা নদীর উপর কল্পনার মোড় থেকে কোর্ট পর্যন্ত যে ১৫টি স্লুইস গেট রয়েছে তা শহরের বাইরের পানি বের হওয়ার জন্য নয়। পদ্মার পানি প্রবেশ করার জন্য এগুলো তৈরি করা হয়েছিল।কারণ, শহরের দক্ষিণে পদ্মা নদী থেকে শহরটি ক্রমাগত উত্তর দিকে ঢালু হয়ে গেছে।এসব স্লুইস গেট দিয়ে পদ্মার পানি খাল দিয়ে উত্তরের ক্ষেতে প্রবেশ করেছে। ভরা ঋতু।বর্ষা শেষে এখান দিয়ে অল্প পরিমাণ পানি নদীতে যেত।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন গঠনের পর আশির দশকে একটি ভুলের কারণে রাজশাহী এখনো ভুগছে। সাফিউদ্দিন বলেন, সিটি করপোরেশন গঠনের আগে পুরো নগরীতে উত্তর দিকে পানি যাওয়ার জন্য অন্তত ২০ ফুট প্রশস্ত ড্রেন ছিল। এসব ড্রেনের নিচে ঢালাই করা হয়নি। ফলে খাল দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় পানি মাটির নিচে চলে যেত। আশির দশকে সিটি করপোরেশন এসব ড্রেন সংস্কার শুরু করে। এরপর বাজেটের অভাবে খালগুলোর প্রস্থ কমে যায়। পরে প্রস্থ আরও কমে যায়। এখন সেসব খালের প্রস্থ ৮ ফুটও নেই। খালের পাশের জমি বেদখল হয়ে গেছে। দখলকৃত জমি পুনরুদ্ধার না করে খালগুলো এখনো কম প্রস্থে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। বর্তমান ড্রেনে আরও বাঁক রয়েছে। ফলে পানির গতি কমে যাচ্ছে। পানির চাপ বাড়লে এখন তা কমতে পারে না।
রাজশাহীর ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আহমেদ সফিউদ্দিন বলেন, “ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত রাজশাহী কলেজের প্রশাসনিক ভবনে একটি বেঞ্চমার্ক রয়েছে। এখানে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শহরের উচ্চতা লেখা আছে। রাস্তার উচ্চতা এর চেয়ে বেশি হতে পারে না। উচ্চতা।কিন্তু কেউ তা দেখে না।প্রতি বছর রাস্তা তৈরি ও সংস্কার করা হচ্ছে।সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতাও বাড়ছে।কোথাও বিশ বছরে রাস্তা ৪০ ইঞ্চি বেড়েছে।এর সাথে পাশের ড্রেন।