Monday , December 30 2024
Breaking News
Home / Countrywide / বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারতের ভণ্ডামি ধরিয়ে দিলেন ভারতীয় হিন্দু শিক্ষাবিদ

বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারতের ভণ্ডামি ধরিয়ে দিলেন ভারতীয় হিন্দু শিক্ষাবিদ

ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভণ্ডামি এবং দ্বিমুখী নীতির কড়া সমালোচনা করেছেন নয়াদিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. অভিজিৎ পাঠক। তার লেখা প্রবন্ধ, “বাংলাদেশে সংখ্যালঘু এবং আমাদের কপটতা”, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি দমন-পীড়ন এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে ভারতের দ্বিমুখী আচরণকে তুলে ধরে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিয়ে ভারতের উদ্বেগ নিছকই রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য দিতে ব্যবহৃত হয়।

১৯ ডিসেম্বর ভারতীয় গণমাধ্যম ‌‌‌’ডেকান হেরাল্ড’-এ প্রকাশিত ড. অভিজিৎ পাঠকের মন্তব্য প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হল-

সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি বা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষকে বিভক্ত করা ক্ষতিকর কাজ। এতে বিদ্বেষ ও সহিংসতায় ভরা বিষাক্ত একটি পরিবেশ তৈরি হয়। আমরা কখন বুঝবো?- এসব কর্মকাণ্ড সাংস্কৃতিক/ধর্মীয় বহুত্ববাদের সাথে বেঁচে থাকার সহানুভূতি, ক্ষমতা এবং গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের নীতিকে লালন করার সাহসকে মূল্যায়ন করা হয় এমন একটি মহৎ আকাঙ্ক্ষার সমাজের বিরুদ্ধে যায়। দেশভাগের সহিংসতার মর্মান্তিক স্মৃতি দ্বারা যন্ত্রণাপ্রাপ্ত ভারতীয় উপমহাদেশ কি এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি গ্রহণ করতে অক্ষম? নাকি আমরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও ধর্মীয় গোঁড়ামির আবর্তে আটকা পড়ে থাকবো? যেমন ধরুন, বাংলাদেশে কী ঘটছে। জনতার অভ্যুত্থান এবং কথিত স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর মতো মৌলবাদী ইসলামী শক্তি পুনরুত্থিত হচ্ছে। হাসিনা যে দলটিকে দমন করতে পেরেছিলেন।

পরবর্তীকালে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের রাজনীতি বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং প্রধানত হিন্দুরা সহ সংখ্যালঘুদের হুমকি-ধামকির মধ্যে রেখেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দুর্গা পূজা উৎসবের সময় মন্দির ও পূজা মন্ডপে হামলা হয়েছে। বাংলাদেশ ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কাউন্সিল’-এর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মণীন্দ্র কুমার নাথের তথ্যমতে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হত্যা, শ্লীলতাহানি এবং অপহরণ সহ ২ হাজার ১০টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে ব্যাপক বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার সংখ্যালঘুদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের অনুসারীদের মধ্যে। ভারত সরকার, যেমন পররাষ্ট্র মন্ত্রী জয়শঙ্করের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনাগুলির একটি ‘গুরুতর নোট’ নেয়া হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে ‘উদ্বেগ’ জানানো হয়েছে। এর বাইরে, অনেক ‘হিন্দু সংগঠন’ হিন্দু সংখ্যালঘুদের এমন অবস্থার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ১৭ কোটি বাংলাদেশি জনসংখ্যার মাত্র ৮ শতাংশ হচ্ছে হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

প্রকৃতপক্ষে, এই বেদনা অন্যরকম সহিংসতায় রূপ নেয়। একদল ‘বিক্ষোভকারী’ আগরতলায় বাংলাদেশের কনস্যুলেট ভবনে ঢুকে ভাঙচুর করে। পশ্চিমবঙ্গে, বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী (বিশেষভাবে সে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি প্রচারের জন্য কোনো পরিচিত ব্যক্তি নয়) বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকল ধরণের আক্রমণাত্মক অঙ্গভঙ্গিতে প্রতিবাদ করতে থাকেন৷ এমনকি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার কিছু হাসপাতাল চিকিৎসা নৈতিকতা ভুলে গিয়ে বাংলাদেশ থেকে আসা রোগীদের চিকিৎসা না করার সিদ্ধান্ত নেয়! প্রকৃতপক্ষে, আপনি এবং আমি যদি প্রামাণিক এবং মননশীল হওয়ার সাহস করি, তবে এটি আমাদের পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন হবে না যে, বাংলাদেশ সংকটে আমাদের প্রতিক্রিয়া প্রাথমিকভাবে কপটতাপূর্ণ; এটি আমাদের দ্বীমুখী নীতি উন্মোচন করেছে। অথবা এটি ভারতের সংখ্যালঘুদের প্রতি আমরা নিজেরা যে ধরনের আচরণ করেছি তার দিকে তাকাতে আমাদের অক্ষমতাকে প্রকাশ করেছে। হিন্দু আধিপত্যবাদী চিন্তাধারার জন্য পরিচিত বর্তমান শাসকগোষ্ঠী কি নিজের সেই রেকর্ডের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হতে পারে?

ভারতে গণপিটুনি থেকে শুরু করে গো-সতর্কতা, ‘বুলডোজার দিয়ে মুসলিমদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুড়িয়ে দেয়াকে ‘ স্বাভাবিকীকরণ করা হয়েছ। একের পর এক সিরিজ মসজিদের নীচে ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগুলিকে ‘আবিষ্কার’ করার মতো বিজয়ী এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়ে চলেছে। গুজরাটে ২০০২ সালের দাঙ্গার ভয়াবহতা থেকে শুরু করে মুসলমানদেরকে “উইপোকা” বা “বাবুর কি আউলাদ” বলে নিশ্চিহ্ন করার সংগঠিত প্রচেষ্টা চলছে। নাগরিক সংশোধনী আইন এবং নাগরিকদের জাতীয় নিবন্ধনের রাজনীতির টার্গেট করা হয়েছে। এমনকি বিজেপিতে একজনও মুসলিম সংসদ সদস্য নেই। কঠোর বাস্তবতা হল ভারতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক/রাজনৈতিক মর্যাদা নিয়ে গর্ব করার মতো কোনো কারণ নেই।

প্রকৃতপক্ষে, গোলওয়ালকর, সাভারকর এবং গডসদের বক্তৃতায় নিহিত থাকা একটি আদর্শ নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ বা গান্ধীর ভালোবাসা ও করুণার ধর্মকে নিন্দা করবে এটাই স্বাভাবিক। সম্ভবত, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য তাদের ‘উদ্বেগ’ নিছকই একটি ভণ্ডামি। এটি একটি ম্যাকিয়াভেলিয়ান হাতিয়ার মাত্র। ভারতে হিন্দু জনতাকে উত্তেজিত করে ‘মুসলিম শত্রুদের’ আরো নিশ্চিহ্ন করা এবং হাইপার-পুরুষালী হিন্দু জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বৈধতা দিতেই এটাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

জঙ্গি হিন্দুত্ব বনাম ইসলামিক মৌলবাদের দুষ্টচক্র থেকে উপমহাদেশের বেরিয়ে আসার কোন সম্ভাবনা আছে কি? অবশ্যই, এটা সম্ভব যদি আমরা একটি নতুন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের দিকে অগ্রসর হই। ধর্মীয় মৌলবাদের সামাজিক মনস্তত্ত্ব যে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃত্ববাদের সাথে গভীরভাবে জড়িত- এই সত্যটি পরিষ্কার বোঝা প্রয়োজন। অন্য কথায়, যদি আমরা একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি রক্ষা করতে চাই, তাহলে পপুলিস্ট/ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ববাদী নেতা এবং ধর্মীয় মৌলবাদীদের অপবিত্র জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করা গুরুত্বপূর্ণ।

একইভাবে, এটি উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ধর্মীয় মৌলবাদের রাজনীতি অন্তর্নিহিতভাবে আধ্যাত্মিক বিস্ময়ের চেতনা বা প্রেম ও করুণার ধর্মের বিরুদ্ধে। প্রতিটি মুহূর্ত মননশীলতা এবং কৃতজ্ঞতার সাথে বাঁচতে আমাদের অনুপ্রাণিত করা থেকে দূর রেখে ধর্মীয় মৌলবাদের বক্তৃতায় নিহিত থাকা ক্রোধ সংখ্যালঘুদের অভিবাসীতে পরিণত করে ‘শত্রু’ গঠন করে চলেছে। আধ্যাত্মিকতা প্রেম এবং একতা নিয়ে আসে আর ধর্মীয় মৌলবাদ বয়ে আনে বিভাজন এবং ঘৃণা।

পরিশেষে, একটি নতুন ধরণের রাজনীতি তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ যা একটি সমতাবাদী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিক সংস্কৃতির জন্য লড়াই করে। সব ধরণের মানসিক এবং শারীরিক ঘেঁটুবাদকে প্রতিহত করতে হবে এবং ‘মুক্তির’ জন্য মক্কা বা অযোধ্যা ভ্রমণের পরিবর্তে সবার জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের মতো সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যদিও এই ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রবক্তা এবং অনুশীলন কারীদের খুঁজে পাওয়া ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। বিপদ হল উপমহাদেশে আরও বেশি করে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, সংখ্যাগরিষ্ঠ আগ্রাসন, সামরিকবাদ ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় এবং একই সাথে নব্য উদারনীতির ফ্যাসিস্টের উত্থান ঘটতে পারে।

সূত্রঃ ভারতীয় গণমাধ্যম ‌‌‌’ডেকান হেরাল্ড’

লেখক ড. অভিজিৎ পাঠক তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বর্তমানে তিনি সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব সোশ্যাল সিস্টেমের প্রফেসর।

About Nasimul Islam

Check Also

কোহিনূরের পর বিশ্বের সবচেয়ে দামি হীরা দরিয়া-ই-নূর বিদেশে পাচার করেছিল শেখ হাসিনা

ঢাকার নবাবি আমলের মহামূল্যবান হীরকখণ্ড ‘দরিয়া-ই-নূর’ নিয়ে রহস্য আজও অমীমাংসিত। ২০১৬ সালে সোনালী ব্যাংক সদরঘাট …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *