ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পলিসি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশে মূল্যবোধ-ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ থেকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেছে। নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চাপ বাংলাদেশকে ক্ষুব্ধ করেছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে চীন ও রাশিয়া। তারা বুঝতে পেরেছে যে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য চাপ দিচ্ছে, বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
কুগেলম্যানের মতে, আমেরিকা যে ভূ-রাজনৈতিক কারণে পিছিয়ে পড়েছে তা হল ওয়াশিংটন-দিল্লি সম্পর্ক। দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক বিষয়ে দুই দেশ একে অন্যের চোখের ভাষা পড়ে নিজেদের অবস্থান বুঝে নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে তাদের অবস্থান এক নয়। কারণ, ভারত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রাখে। তাই আওয়ামী লীগের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ প্রকারান্তরে ভারতকে উপেক্ষা করা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে গেলে তা দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে পার্থক্য দূর করতে সাহায্য করবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়া বন্ধ করে এবং নতুন কোনো কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে তা বাংলাদেশের ওপর দুই পক্ষের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেবে। চীন, রাশিয়া ও মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বারবার কথা বললেও সেসব দেশে কোনো পরিবর্তন নেই। কারণ সেসব দেশে একনায়কতন্ত্র আছে।
কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কেউ কেউ বলতে পারেন যে বাংলাদেশ একনায়কতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ঐতিহ্য রয়েছে। এ জন্য বাংলাদেশকে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের কৌতূহল রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চাপ সত্ত্বেও বাংলাদেশে নির্বাচনের কারণে আগামীতে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক কেমন হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে কুগেলম্যান বলেন, আমার ব্যক্তিগত মতে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সম্পর্কের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকবে বাংলাদেশের সাথে। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র কোনো ঝুঁকি নেবে না। বাংলাদেশের গুরুত্বের পেছনে অন্যতম কারণ এই অঞ্চলকে ঘিরে বড় শক্তির প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা, ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বেড়েছে এবং অতীতের মতো বাংলাদেশেও রাশিয়ার শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র এমন কিছু করবে না যা বাংলাদেশকে চীন বা রাশিয়া বা উভয়ের কাছাকাছি হতে বাধ্য করবে।
তিনি আরও বলেন, অন্যদিকে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্কের পরিধি বাড়ছে। বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাপক পরিসরে আমরা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করছি। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে না বাংলাদেশে বিপুল বিনিয়োগের সুবিধাটা শুধু চীনই উপভোগ করুক। তাই কৌশলগত ও বাণিজ্য সহযোগিতার নিরিখে এবং বড় শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে নিবিড় করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগ থাকবে।
কুগেলম্যান বলেন, বাংলাদেশ সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সেটা বেশ স্পষ্ট। এতে বলা হয়েছে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রে গুরুত্ব অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকবে বাংলাদেশ। একই সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের কৌশলগত দিককেও বিবেচনায় নেবে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ মোকাবিলাসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব থাকবে।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ প্রসঙ্গে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে মূল্যবোধ ও স্বার্থের ভারসাম্য রাখতে চায়, কিন্তু কাজটি সহজ নয়। এর একটি কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মার্কিন ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশেষ করে প্রভাবশালী মহলের মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর আগ্রহ রয়েছে। অন্যদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) প্রয়োগ, ফেসবুকে সরকারের সমালোচনার কারণে গ্রেপ্তার ও হেফাজতে মৃ”ত্যুর মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও ঘটেছে। যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাত থেকে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করছে, ইন্টারনেট অনুশীলনের চিত্রটি স্বস্তিদায়ক নয়।