বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তেজনায় ভরপুর। এটি কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভ এবং সহিংস সংঘর্ষে খুব খারাপ অবস্থায় পৌছায়। ৭ জানুয়ারির জন্য নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে শঙ্কার ছায়া ফেলেছে। প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা পুনরুত্থিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ জোরদার করেছে।
সাধারণ নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে এই অসন্তোষের কেন্দ্রবিন্দু ঘোরে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার সেই দাবি দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিরোধের এই একক ক্ষেত্র আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে বিভেদ আরও গভীর করে তুলেছে। আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আকাঙ্ক্ষা আরও জোরালো হয়েছে, যা আরও প্রসারিত রাজনৈতিক খাদকে চিত্রিত করেছে। প্রধান দুই দলই অর্থপূর্ণ সংলাপ করতে অনীহা প্রদর্শন করে৷ যার ফলে আসন্ন নির্বাচনের আগে তাদের পুনর্মিলনের সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ থাকে।
একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী নির্বাচনী সরকারের জন্য তাদের ‘এক দফা দাবি’ সমর্থনে যথেষ্ট শক্তি প্রদর্শনে ২৮ অক্টোবর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ‘গণ সমাবেশ’ করে। জবাবে আওয়ামী লীগ ওই দিনই ‘শান্তি সমাবেশের’ ডাক দেয়। দুঃখজনকভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হওয়া সমাবেশটি সহিংসতায় পরিণত হয়, নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য পুলিশের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল।
এ সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ হয়। প্রাথমিকভাবে পুলিশি ব্যারিকেড থাকা সত্ত্বেও বিএনপির সমাবেশ থেকে দিনব্যাপী চলা এ সংঘর্ষ সহিংস রূপ নেয়। দাঙ্গায় উল্লেখযোগ্য হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিএনপি সমর্থকরা পুলিশ-সাংবাদিকদের ওপর হামলা, পুলিশ হাসপাতালে অগ্নিসংযোগ, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা-এমন অভিযোগ রয়েছে।
বিএনপি অভিযোগ করে যে, হয় ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংসতা উস্কে দেওয়া হয়েছে অথবা তাদের বিক্ষোভকে নস্যাৎ করতে সরকার নাশ”কতার অংশ। তবে বিশ্বাসযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসের কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেছে সরকার। অক্টোবরের নৃশংসতার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ এই পদক্ষেপকে প্রয়োজনীয় প্রতিক্রিয়া হিসাবে স্বাগত জানিয়েছে।
পরবর্তীতে বিরোধী দল নিজেদের রাজনৈতিক কৌশল জনবিক্ষোভ থেকে পরিবর্তন করে দেশব্যাপী হরতাল ও অবরোধে নিয়ে যায়। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত অন্তত ১৮০টি গণপরিবহনে আগুন দেয়া হয়েছে। এসব ঘটনাকে বিএনপি সরকারি সংস্থা বা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত নাশকতা হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে এই অবরোধ ও ধর্মঘটকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।
আমার মতে, ২৮ অক্টোবর সহিংসতা উসকে দিয়ে বিএনপি এবং তার মিত্ররা অনিচ্ছাকৃতভাবে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কূটকৌশলের মধ্যে পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংগঠিত এই ‘ম্যাকিয়াভেলিয়ান’ চক্রান্তকে এড়িয়ে যাওয়াই বিএনপির জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। যার ফলে এর অহিংস প্রচারাভিযানের দৃশ্যমানতা বৃদ্ধি পাবে এবং উচ্চতর জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে একটি দুর্দান্ত বার্তা পৌঁছে দেয়া যাবে।
ওয়াশিংটনের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) চীনকে ভারসাম্যহীন করার জন্য কৌশলগতভাবে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোটের সূচনাকে চিহ্নিত করে। পরাশক্তির এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের এক যুগসন্ধিক্ষণের মধ্যে খুঁজে পাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মেয়াদের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং প্রধানত পশ্চিমা সরকারগুলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ প্রয়োগ করে আসছে। উল্লেখ্য যে, বিরোধী দল বিএনপি এবং তার মিত্ররা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার গত এক দশকে ভারতের কাছ থেকে বেশ ভালো পরিমান সমর্থন উপভোগ করেছে। যাইহোক, ভারতে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক G-20 শীর্ষ সম্মেলনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি তার নীতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতকে পূর্ণ নেতৃত্ব প্রদানে তার অনিচ্ছার ইঙ্গিত দেয়। ভারতে অনুষ্ঠিত টু প্লাস টু সংলাপে বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে পার্থক্য প্রকাশ পায়। বিপরীতে, চীন ও রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে, তাদের পদক্ষেপকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযৌক্তিক “হস্তক্ষেপ” বলে চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে রাশিয়া ও চীনের অবস্থানের নিন্দা জানিয়েছে বিএনপি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে পশ্চিমা দেশগুলো সংলাপের কথা বলেছে। দলগুলো মাঝেমধ্যে সংলাপে সম্মত হলেও ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর এই সুযোগ বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে বিএনপি তুলনামূলকভাবে নীরব এবং আ.লীগের সাথে বসতে খুব কমই আগ্রহী।
অর্থনৈতিক সংকটের পটভূমিকায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও প্রকাশ পাচ্ছে। জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়, বিশেষ করে খাদ্যের দামের সাথে লড়াই করছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অর্ধেক হয়েছে, যা ২০২৩ সালের জুলাই মাসে $৪২ বিলিয়ন থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। এই বছরের শুরুতে, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে সহায়তা চেয়েছিল। বাংলাদেশের শ্রম আইন সংস্কার নিয়ে সাম্প্রতিক মার্কিন উদ্বেগগুলি রপ্তানি ও আমদানির ক্ষেত্রে দেশের পোশাক খাতের জন্য সম্ভাব্য ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত দেয়৷
পশ্চিমা ‘লিভারেজ’ কাজে লাগানো এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের জন্য জনগণের অসন্তোষকে পুঁজি করা বিএনপির কৌশলের লক্ষ্য। আন্দোলন করে তারা হয় হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে চায়, নয়তো সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে তাকে কোণঠাসা করতে চায়, যাতে বৃহত্তর রাজনৈতিক সংঘা”তের সূত্রপাত হয়। এই সীমিত প্রেক্ষাপটে, হাসিনার কাছে দুটি বিকল্প রয়েছে: নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্বহাল করা বা সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। যদিও সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপির পক্ষে নাও হতে পারে, তবে এটি শেষ পর্যন্ত খেলার ক্ষেত্র সমান করতে পারে। বিপরীতে আওয়ামী লীগ প্রতিকূলতার মধ্যে সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করে নৈতিক শক্তি অর্জন করে।
আইনি চাপ বিএনপি নেতা তারেক রহমানের ‘কমান্ড’ ও ‘কন্ট্রোল’ ব্যাহত করতে পারে বলে মনে করছেন তারা। বিএনপির চেইন অব কমান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য ঢাকায় ফিরে আসা এবং সম্ভাব্য কারাবাস অথবা প্রবাসে রাজনৈতিক বিপর্যয় মেনে নেওয়ার মধ্যে তারেককে বেছে নিতে বাধ্য করা হবে।
ক্রমাগত অস্থিরতার মধ্যে, সমাবেশের স্বাধীনতার অধিকারকে সমুন্নত রাখা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের নিরাপত্তা রক্ষা করা অপরিহার্য। কিন্তু, এটা একটা বিশাল কাজ। এই বিস্তৃত এবং তীব্রভাবে জটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, আপসকে রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসাবেও বিবেচনা করা হয়।
১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য বাহ্যিক চাপ বা অভ্যন্তরীণ শক্তির খেলার অধীন নয়। প্রকৃত ক্ষমতা সাধারন মানুষের উপর নির্ভর করে এবং তাদের বুঝতে পারা উচিৎ কখন এবং কিভাবে তাদের কর্তৃত্ব জাহির করতে হবে।