দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে নানা ধরনের বিশ্লেষণ। ঢাকায় কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকরাও এবারের নির্বাচনের দিকে কড়া নজর রাখছেন। পশ্চিমা কিছু কূটনীতিকের পর্যবেক্ষণ হলো, বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব রয়েছে এবং ভোটারদের হাতে প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার প্রকৃত বিকল্প নেই। ফলে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী হবে আওয়ামী লীগ।
ঢাকায় পশ্চিমা কয়েকটি দেশের দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, ভোট ঘোষণার পর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তারা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এরই মধ্যে প্রতিবেদনটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে তাদের নিজ নিজ দেশ। সেসব দেশের কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে তারা সবাই প্রায় একই রকম পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কেউ।
পশ্চিমা প্রভাবশালী এক দেশের কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে নির্বাচনে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা জোটের দলগুলো নির্বাচন বর্জন করেছে, ভোটারদের কাছে কোনো বিকল্প নেই।
এ নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন দূতাবাস। সেই সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তার কথাও তারা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সব রাজনৈতিক দলকে রাজি করাতে না পারায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) আক্ষেপ রয়েছে। ইইউভুক্ত দেশের এক কূটনীতিক বলেন, রাজনীতিতে বহুত্ববাদ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সবার মেনে চলা উচিত। এগুলো দেশের উন্নয়নে ধারাবাহিকতা রাখতে সহায়তা করে। আর বাংলাদেশকে তা ইইউর জিএসপি প্লাস পেতে সহায়তা করবে। কারণ ইইউর জিএসপি প্লাসের অন্যতম শর্ত হলো– গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও সুশাসন। ওই কূটনীতিক জানান, নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইইউর একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশ সফর করছে। তারা তাদের প্রতিবেদন দেবে ভোটের কয়েক সপ্তাহ পর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, নির্বাচন যেভাবে চলছে তাতে তাকে ক্ষমতাসীন দলের যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে বললে ভুল হবে না। কারণ পুরো বিষয়টি যেভাবে সামনে এসেছে তাতে আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের একজন নৌকা প্রতীক পেয়েছেন, অন্যজন পাননি।
তবে এই বাস্তবতাকে পশ্চিমা বেশির ভাগ দেশ মেনে নিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এক দিনের বাচ্চাকে যদি দৌড়াতে বলি এবং দৌড়াতে না পারার কারণে তাকে শাস্তি দিই, তবে তা ওই বাচ্চার প্রতি অবিচার হবে। তা ছাড়া বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রতিটি দেশের নিজস্ব অগ্রাধিকার রয়েছে, যা অন্যদের থেকে ভিন্ন। পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে ওই অগ্রাধিকার মাথায় রেখে।’ এই কূটনীতিক আরও বলেন, ‘পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্রই তুলে ধরতে হয়। তবে এর মানে এই নয় যে, আমাদের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে।’
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সঙ্গে কথা বলেছেন আরেক পশ্চিমা কূটনীতিক। তবে তিনিও তার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। এই কূটনীতিক বলেন, “তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করার পর আমি বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে এসেছি। সরকার পরিবর্তন হলে তা নতুন করে শুরু করতে হবে। এর ফলে আমাদের রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে।
বাংলাদেশের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান ঘোষণা করেছে। তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হলে ভিসা দেওয়া হবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছে ওয়াশিংটন। এদিকে রাশিয়া, ভারত ও চীন বলেছে, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; বরং তারা মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। এ ছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, জাপানসহ প্রতিটি দেশেরই বাংলাদেশ সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশলগত লক্ষ্য ও অগ্রাধিকার রয়েছে।
বিদেশি কূটনীতিকরা বলছেন, মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, গণতন্ত্র ও সুশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিবর্তে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার মানসিকতায় রয়েছেন। ২০৩২ সাল পর্যন্ত ইইউতে বাংলাদেশি পণ্যের জন্য জিএসপি সুবিধা বজায় রাখা এবং শ্রম খাতের অগ্রগতিকে সমর্থন করার ঘটনাটি একটি নজির।
ঢাকায় নিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বলেন, “জিএসপির মতো বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে ইইউর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। ইইউ তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেয়, তবে মিত্রদের সঙ্গেও পরামর্শ করে।”