Friday , November 15 2024
Breaking News
Home / Countrywide / বঙ্গবন্ধু নিজে মাহবুব তালুকদারকে বলেছেন, ‘মাহবুব তুমি আমার সঙ্গে থাকবে : মোর্তোজা

বঙ্গবন্ধু নিজে মাহবুব তালুকদারকে বলেছেন, ‘মাহবুব তুমি আমার সঙ্গে থাকবে : মোর্তোজা

সম্প্রতি সাবেক ইসি মাহবুব তালুকদারের প্রয়াণে তার ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তার কর্মের প্রশংসা করে বিবৃতি দেন এবং শোক প্রকাশ করেন। যদিও অনেকে তার কর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অপ্রিয় হলেও তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতেন নির্বাচন নিয়ে। তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি ইতিবাচক কথা বলতেন যা এখনো পর্যন্ত কোনো নির্বাচন কমিশন বলতে পারে নাই।

নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সাধারণত ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হয় না। কিন্তু, মাহবুব তালুকদারের হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ৫ বছরের পুরো সময়কালে অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর পরিস্থিতিতে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন কোনো অর্থেই ইতিবাচকভাবে পরিচিত নয়। জনআস্থাহীন নির্বাচন কমিশন ভোটারবিহীন ও রাতে ভোটের কমিশন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সেই নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্য মাহবুব তালুকদার সম্পর্কে জনমানুষের পারসেপশন তৈরি হয়েছে যে, তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। জনমানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সব রকমের প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে স্রোতের প্রতিকূলে অবস্থান নিয়ে সদা সত্য কথা বলে গেছেন। অন্য কেউ যে কথাটি বলেননি, তিনি সেই কথাটি বলেছেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে, নির্বাচন রাতে হয় সেটা বলা থেকে শুরু করে, কোন জায়গায় ত্রুটি, কোন নির্বাচনগুলো সঠিকভাবে হয়নি, গণতন্ত্র বিপন্ন— এই বিষয়গুলো তিনি তার পুরো সময়কালে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে গেছেন।

কালোকে কালো আর সাদাকে সাদা বলতে পারে এমন মানুষ আজকাল খুব একটা নেই। এ ক্ষেত্রে সামনের কাতারের একজন হিসেবে নজির রেখে গেছেন মাহবুব তালুকদার।

লেখক মাহবুব তালুকদার নির্বাচন কমিশনার হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমলাতান্ত্রিক পরিচয়ের বাইরে আলাদা পরিচয় ছিল।

তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের একজন। লিখেছেন গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, গল্প, নাটক, গবেষণা প্রবন্ধ। সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই বিচরণ করেছেন। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে তিনি স্থান পান। তার গল্প, উপন্যাস সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়, যখন বিচিত্রা দেশের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্র ছিল।

নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর হয়তো লেখক মাহবুব তালুকদারের পরিচয় কিছুটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। যে লেখাগুলোর কথা বললাম, এর বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষমতার কেন্দ্রের এক প্রামাণ্য দলিল মাহবুব তালুকদারের দুটি বই ‘বঙ্গভবনে পাঁচ বছর’ ও ‘আমলার আমলনামা’।

আমরা জানি যে মাহবুব তালুকদার বঙ্গবন্ধু সরকারের সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছেন। বাকশাল গঠনের পর বঙ্গবন্ধু নিজে মাহবুব তালুকদারকে বলেছেন, ‘মাহবুব তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।’ বঙ্গবন্ধু অন্য সবাইকে যেমন আদর-স্নেহ করতেন, একইভাবে মাহবুব তালুকদারকেও করতেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হ/ত্যার পর খড়গ পড়ে মাহবুব তালুকদারের ওপর। তাকে ওএসডি করা হয়েছে, পদাবনতি করা হয়েছে, নানাভাবে জুলুম করা হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, তার বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘ নিজের লেখা বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘পঁচাত্তরের পট-পরিবর্তনের পর ওএসডি হওয়া আমার জন্য ছিল এক গৌরবজনক ঘটনা। এতদিনে যেন রাজপুত্রের কপালে মুকুট পড়েছে। বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নি/হত হন, তখন এই সামান্য কষ্টকে মেনে নেওয়ার মধ্যে এক ধরনের সহানুভূতি অনুভব করি। এটাই আমার প্রাপ্য। পরে মনে হলো, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার ফলে কর্মক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় সম্মান আর নেই। চাকরি চলে গেলেও আমার কোনও কুণ্ঠা ছিল না। তাই ওএসডি হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করলাম।’ (আমলার আমলনামা)

“একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ভোট হয়েছে, এটা একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য”

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর অনুলেখক ছিলেন মাহবুব তালুকদার। বঙ্গবন্ধু বলবেন, রেকর্ড করে লিখবেন। জ জন্মকাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত টাইপ করা ৩০০ পাতা আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতও হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট মাহবুব তালুকদার তার অফিসের ড্রয়ারে রেখে এসেছিলেন। ১৫ আগস্টের পর আর তা উদ্ধার করতে পারেননি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু আমলের বহু নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেন এরশাদ। ধারণা করা হয়, পুড়িয়ে ফেলা নথির মধ্যে হয়তো বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপিও ছিল।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি ভাষণ রেকর্ড করার দায়িত্বে ছিলেন সহকারী প্রেস সচিব মাহবুব তালুকদার। স্পুলে রেকর্ড করা বক্তৃতা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিঠি, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের নথি মাহবুব তালুকদারের কাছে রাখা ছিল। যা তিনি নির্বাচন কমিশনার থাকাকালীন ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেন। এসবই তিনি তার অপ্রকাশিত গ্রন্থ ‘নির্বাচননামা’-এ বিস্তারিত লিখেছেন।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের পরিচয় তৈরি হলেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ ও বিএনপির সমর্থক। এটা সত্য যে, নির্বাচন কমিশনার হিসেবে বিএনপি তার নাম প্রস্তাব করেছিল। বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে একাধিকবার কথা হয়েছে। তার বক্তব্য ছিল, ‘বঙ্গভবনের পাঁচ সার’ গ্রন্থে জিয়াউর রহমানের কঠোর সমালোচনা করেছি। বেগম খালেদা জিয়ার আমলে আমি ১ হাজার ২২৩ দিন ওএসডি ছিলাম। বঙ্গবন্ধু, শেখ কামাল, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ মনি, সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলতে আমার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু দেশ ও জাতির কথা ভেবে কথা না বলে উপায় নেই। তিনি সাজানো নির্বাচন ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় দেশকে অনিশ্চিত গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন।’

এই কথাগুলো ‘নির্বাচন ফর্মে’ ব্যাপক পরিসরে লেখা হয়েছে।

মাহবুব তালুকদার ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার প্রভাষক ছিলেন। কলকাতায় যান। তিনি তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

আর এই কথাগুলো ‘নির্বাচন ফর্মে’ ব্যাপক পরিসরে লেখা হয়েছে।

মাহবুব তালুকদার ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার প্রভাষক ছিলেন। কলকাতায় যান। তিনি তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে তিনি শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

কর্মজীবনের শুরুতে ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করেছেন। শিক্ষকতা করেছেন জগন্নাথ কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মাহবুব তালুকদার ছিলেন অত্যন্ত সংগঠিত, যোগ্য, দক্ষ ও কর্মদক্ষ ব্যক্তি। তিনি তার কর্মকাণ্ডকে শুধু নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে কথাগুলো বলেছেন তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। নির্বাচন কমিশনে ৫ বছর দায়িত্ব পালনকালে তিনি প্রায় ১২০০ পৃষ্ঠার একটি বই লিখেছেন সেই সময়ে কী ঘটেছিল, তার পর্যবেক্ষণ, অবিচার এবং পর্দার অন্তরালে।

আলাপচারিতায় তিনি একটি কথা বললেন, ‘আমি বেঁচে থাকতে এ বই প্রকাশ করা সম্ভব হবে না, প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এতে অনেক সংবেদনশীল তথ্য রয়েছে। আমার মৃত্যুর পর এই বইটি প্রকাশিত হবে।’

বইটি প্রকাশিত হলে জানা যাবে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন সংক্রান্ত অনেক অজানা গল্প।

মাহবুব তালুকদার ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, নানা দিকে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি একজন যোগ্য আমলা, দক্ষ প্রশাসক, শক্তিশালী লেখক। যারা অনেক দিক দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের জন্য, যদি এক দিক অতিমাত্রায় থাকে, তবে অন্য দিকগুলি প্রায়শই চাপা পড়ে যায়। লেখক হিসেবে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সুনাম হয়তো ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ মাহবুব তালুকদারকে স্মরণ করবে তার সাহসী, দৃঢ় অবস্থান, সত্যবাদিতা ও সততার জন্য।

মাহবুব তালুকদার যখন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নিতে আসেন, তখন তিনি জানতেন তার জীবন শেষ হয়ে আসছে। শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ছে। সে কতদিন বাঁচবে তার একটা ধারণা ছিল। মৃত্যুর কথা ভেবে বা হতাশার কথা ভেবে বাকি দিনগুলো নষ্ট করেননি। তিনি তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যবহার করেছেন।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের দীর্ঘ ৫ বছর একাকী কাটিয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পুরো কমিশনের আচরণ ছিল আজ্ঞাবহ। ব্যতিক্রম ছিলেন মাহবুব তালুকদার। তিনি নজির স্থাপন করেছেন যে সোজা-সমর্থিত লোকেরা এখনও বিদ্যমান, যে সম্মিলিত আনুগত্যকে সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে একাই চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। তার ওপর ক্ষমতাসীনরা ক্ষুব্ধ। কিন্তু, মাহবুব তালুকদার মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত।

প্রসঙ্গত, সাবেক এই ইসি দায়্ত্বি থাকাকালীন সময়ে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল কিন্তু তার ভূমিকা ছিল ইতিবাচক এমনটায় বলা হয়েছে। আওয়ামীলীগের ঘনিষ্ট হওয়ার সত্বেও তিনি সঠিক বিষয়টি তুল ধরতে পিছুপা হননি তিনি।

About Babu

Check Also

উপদেষ্টা পরিষদেই বৈষম্য

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে আঞ্চলিক বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। ২৪ সদস্যের এই পরিষদে ১৩ জনই চট্টগ্রাম …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *