রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান সংকটের কারণে আমদানি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আরো বলেছিলেন, উক্ত দুই দেশের অভ্যান্তরীন চলমান সংকটের কারণে দেশীয় সকল পণ্যের দাম যেমন বাড়ছে, তেমনি আমদানি করতে হয় এমন সব পণ্যের দামও বাড়ছে। তিনি আরও বলেছিলেন, সবকিছুর দাম এতটাই বেড়েছে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটা অনেক ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। এই সকল পারিপার্শিক বিভিন্ন সংকটের কারনে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সাময়িক বদ্ধের ঘোষনা দিয়েছিল সরকার।
দামি ও বহুল আলোচিত ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আবার চালু হচ্ছে। পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কিছুটা কমার যুক্তি দিয়েই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের যেসব অংশে ডিজেল ছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয় সেখানে কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট পুনরায় চালু করা হচ্ছে। এটি জাতীয় গ্রিডে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যোগ করতে পারে। মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এ কারণে সরকারি-বেসরকারি অফিস, দোকানপাট, শপিংমল ও অ্যাপার্টমেন্টে চলমান জেনারেটরে ডিজেলের পরিমাণ বেশি। একদিকে ডিজেলের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে এসব জেনারেটর বেশি ডিজেল ব্যবহার করে কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। তাই লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি করতে এবং ডিজেলের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দক্ষ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে গড়ে ২২ থেকে ৫৩ টাকা খরচ হয়। কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতিটি ইউনিটে গড়ে মাত্র ১৫ পয়সা খরচ হচ্ছে। আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয় টাকা। প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ আরও কম। ডিজেল পাওয়ার প্লান্ট চালু হলে একদিকে তেল কিনতে বিপুল পরিমাণ ডলার খরচ হবে, অন্যদিকে এই বিদ্যুতের দাম মেটাতে সরকারি কোষাগারে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে। তাই এই সময়ে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু না করাই ভালো। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ৬৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে ১০ হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা মোট উৎপাদনের ৫১ শতাংশ। প্রাকৃতিক গ্যাসের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও কম। তাছাড়া শিল্প কারখানা ও ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টে ব্যবহৃত বয়লারও এই গ্যাস দিয়ে চলে। কিন্তু তারপরও দেশীয় গ্যাস উৎপাদনে সরকার কোনো বড় ভূমিকা নিচ্ছে না। মাটির নিচে বিপুল গ্যাসের মজুদ থাকলেও রহস্যজনক কারণে এ গ্যাস উৎপাদনে বিলম্ব করছে জ্বালানি বিভাগ।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ (আমদানিসহ) ছিল ৭ হাজার ৮৫২ কোটি ৫৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় ৪৯ হাজার ২৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় খরচ ৬ টাকা ২৭ পয়সা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম খরচ হয় জলবিদ্যুতে। সবচেয়ে বেশি খরচ হয়েছে টাকা। ডিজেলে ৫৩। চলতি অর্থবছরে ডিজেল চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষমতা ছিল ১২০০ মেগাওয়াট। এসব কেন্দ্রে ৬০ কোটি ৭২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এতে ব্যয় হয় তিন হাজার ২২৯ কোটি সাত লাখ টাকা। প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ দাঁড়িয়েছে ৫৩ টাকা ১৮ পয়সা। ২০২০-২১ অর্থবছরে, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ৬৫ কোটি ৫০ লাখ কিলোওয়াট ঘন্টা। এর দাম ১৮২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। ফলে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ মাত্র দুই টাকা ৭৯ পয়সা।
এছাড়া প্রায় ৬৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে ১০ হাজার ৮৭৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা মোট উৎপাদনের ৫১ শতাংশ। এবং ৬৪টি পাওয়ার স্টেশন ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে ৫,৯২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যা মোট উৎপাদনের ২৮ শতাংশ। ভূগর্ভস্থ গ্যাস স্টোরেজ নিয়ে হাহাকার, ভূগর্ভস্থ গ্যাসের বিশাল মজুদ সঠিকভাবে উত্তোলন হচ্ছে না। জানা গেছে, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো এমন সময়েও বিপুল মজুদ নিয়ে বসে আছে যখন গ্যাস নিয়ে হৈচৈ শুরু হয়েছে। আমেরিকান কোম্পানি শেভরন বিবিয়ানায় ১.২২ টিসিএফ রিজার্ভ থেকে দৈনিক ১২৩৭ এমএমসিএফ উৎপাদন করছে। মজুদ প্রায় দ্বিগুণ (২.০২৬ টিসিএফ) থাকা সত্ত্বেও কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্র থেকে মাত্র ৬৮ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। তিতাস ও রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রেও বিবিয়ানার চেয়ে বেশি গ্যাসের মজুদ রয়েছে। সেখানেও আশানুরূপ উৎপাদন হচ্ছে না। ১৯৬০ সালে আবিষ্কৃত, রশিদপুর গ্যাস ক্ষেত্রে অবশিষ্ট মজুদ (প্রমাণিত এবং সম্ভাব্য সম্মিলিত) (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ অনুযায়ী) ১.৭৭৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। গত ১ জুলাই রশিদপুরে মাত্র ৪৪ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়।
রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৯ নম্বর কূপটি ২০১৭ সাল থেকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত থাকলেও বসে আছে। কূপটি প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৯ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস উত্পাদন করতে পারে। আমদানিকৃত (১৯ মিলিয়ন) এলএনজির সঙ্গে তুলনা করলে দৈনিক মূল্য ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকার ওপরে। এই অর্থের পরিমাণ বছরে প্রায় ১৮০০ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলার যুক্তি, কূপের সঙ্গে পাইপলাইন না থাকায় গ্যাস উত্তোলন করা যাচ্ছে না। কূপ থেকে গ্রিডে গ্যাস আনার জন্য একটি ১৭ কিলোমিটার পাইপলাইন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কূপ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে রশিদপুর ৭ নম্বর কূপের পাইপলাইন রয়েছে। সেখানে হুক আপ করলেই গ্যাস সরবরাহ পাওয়া সম্ভব। পাইপটি সেবাযোগ্য বলেও জানা গেছে। কিন্তু চরম সংকটের মধ্যেও ৩৫ বছর ধরে রাখা হয়েছে কূপটি।
রশিদপুর গ্যাস ফিল্ডের মালিকানা সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, হাইড্রো টেস্টে পুরনো পাইপ ব্যবহার উপযোগী পাওয়া গেছে। পাইপলাইন নির্মাণের জন্য ১৭ কিলোমিটার প্রকল্পে, টেন্ডারে লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ানো বা কমানোর বিকল্প ছিল। এখন পুরোনো পাইপলাইন দিয়ে হুকিংয়ের জন্য যে পরিমাণ লাইন বসাতে হবে তা করা হবে। আশা করা যাচ্ছে যে ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে উৎপাদন সম্ভব হবে। তিতাস গ্যাসক্ষেত্রেও বিবিয়ানার চেয়ে প্রায় দেড় গুণ বেশি মজুদ রয়েছে। ১৯৬২ সালে অনাবিষ্কৃত টাইটাস গ্যাস ক্ষেত্রে অবশিষ্ট মজুদ রয়েছে (প্রমাণিত এবং সম্ভাব্য একত্রিত) ১.৪৩৬ টিসিএফ (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ অনুযায়ী)। সেখানে দৈনিক মাত্র ৪১০ এমএমসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। যা বিবিয়ানার তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, বিবিয়ানা নতুন এলাকায় অনুসন্ধান কূপ খননের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গ্যাস পাওয়া গেলে আরও ৩টি কূপ খনন করা হবে। সফল হলে, গ্যাস উত্তোলন ২০০ mmcfd বৃদ্ধি পাবে।
উল্লেখ্য, রাশিয়া-ইউক্রেনের সংকটের কারনে এশিয়ার স্বল্প আয়ের দেশগুলোর উপরে মন্দা প্রভাব পরেছে। সার্বিক দিকে পর্যালোচনা করে দেখলে বিশেষভাবে প্রায় দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় আমদানি পন্যের পাশাপাশি জালানী ও ভোজ্য তেলের উপরে এর বেশি প্রভাব পরেছে। যার প্রভাবে মন্দার প্রকোপে পরে থাকার তালিকাভুক্ত দেশগুলোর ভিতরে জালানী তেলের প্রভাবে অনেক খাতে বেশ ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে।