একসময় গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি আজ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় হিমশিম খাচ্ছে। কোম্পানিটির এই করুণ অবস্থার পেছনে দায়ী সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও লুটপাট। তাদের অপকর্মের কারণে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, যা প্রতিষ্ঠানটিকে চরম আর্থিক সংকটে ফেলে দিয়েছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কোম্পানিটি থেকে মোট ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৪৩২ কোটি টাকারও অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ফারইস্ট ঢাকাসহ দেশের ১৪টি স্থানে জমি কেনে। এসব জমি বাজারদরের তুলনায় বহুগুণ বেশি দামে কেনা হয়। জমি কেনা ও ভবন নির্মাণের নামে প্রায় ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ির ১৯ কোটি টাকার জমি কেনার হিসাব দেখানো হয়েছে ১৯৯ কোটি টাকায়। কাকরাইল ও গুলশান এলাকার জমি কেনার ক্ষেত্রেও একইভাবে বিশাল অঙ্কের টাকা লোপাট হয়েছে।
জমি কেনার নামে দুর্নীতির পাশাপাশি, বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা ফারইস্টের মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট রিসিট (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে পরিচালকদের নামে ঋণ নেয়া হয়। এই পদ্ধতিতে ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন নজরুল-খালেক গং। বিশেষ করে এম এ খালেক, প্রাইম প্রোপার্টি, ম্যাকসন্স, এবং মিজানুর রহমানের মতো নামগুলো এই দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
এছাড়াও, কোম্পানিটির তহবিল ক্ষতিকর বিনিয়োগের মাধ্যমে আরও প্রায় ২৮৭ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। এর মধ্যে, বিভিন্ন ভুয়া ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে কর্মকর্তা ও পরিচালকদের নামে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম কেবল দেশেই নয়, বিদেশেও দুর্নীতির অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মিয়ামি এলাকায় তিনি বিলাসবহুল একটি বাড়ি কিনেছেন। এই বাড়ির দাম ছিল ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৩২৭ ডলার, যা সম্পূর্ণ নগদ পরিশোধ করা হয়েছিল। এছাড়া তার সন্তানদের নামে যুক্তরাষ্ট্রে আরও তিনটি কোম্পানি গড়ে তোলার তথ্য পাওয়া গেছে।
নজরুল ইসলামের জীবনের শুরুটা ছিল একেবারে ভিন্ন। মুন্সীগঞ্জের দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এই ব্যক্তি ১৯৮৮ সালে জাপানে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যান। সেখান থেকে ফেরার পর হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে তিনি ফারইস্টের মালিকানা গ্রহণ করেন এবং দলীয় প্রভাব খাটিয়ে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হন।
বর্তমানে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি হাজার হাজার গ্রাহকের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। বীমার টাকা ফেরত না পেয়ে গ্রাহকরা দিশেহারা। আর এই অবস্থার জন্য সরাসরি দায়ী নজরুল ইসলাম, এম এ খালেক এবং তাদের সহযোগীদের দুর্নীতি। এই দুর্নীতি নিয়ে একাধিক মামলা চলছে, এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। কিন্তু এত বড় অঙ্কের অর্থ লোপাটের পর প্রতিষ্ঠানটি আদৌ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।