সম্প্রতি আধিপাত্য বিস্তার কেন্দ্র করে নিজেদের ভিতরে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা। যার ফলে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে। এতে দলের শীর্ষ নেতাদের প্রশ্নে মুখে পড়তে হচ্ছে। দলের প্রতি নেতিবাচক ধারনার সৃষ্টি হচ্ছে সমাজে। এবার মেয়রকে কোপানোর কথা বলে এমপির ফোনালাপ নিয়ে যে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
বরিশাল-৪ (হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) পঙ্কজ দেবনাথের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীদের সম্পর্কটা দা-কুমড়া। রাজনৈতিক বিবাদের জের ধরে একাধিকবার রক্তও ঝরেছে এই জনপদে। দু’পক্ষের লড়াইয়ে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ নেতাকর্মী। পঙ্গুও হয়েছেন অনেকে।
গত ৪ জুলাই রাতে মেহেন্দিগঞ্জ শহরের চরহোগলায় এমপিবিরোধী স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রাতুল চৌধুরীর দুই হাতের রগ কেটে দেন প্রতিপক্ষ। এর মধ্যেই দু’দিন ধরে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের ১ মিনিট ৯ সেকেন্ডের একটি কল রেকর্ড ছড়িয়ে পড়লে মেহেন্দীগঞ্জে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
সেই কথোপকথন সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ ও মেহেন্দিগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. তৌহিদুজ্জামানের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। তবে সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ দেশের একটি অন্যতম সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, অডিও ক্লিপটি প্রতিপক্ষের সাজানো। তার কণ্ঠ ডাবিং করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত করা হলে আইসিটি আইনে মামলা করার কথাও বলেন তিনি।
ওই অডিওতে অন্য প্রান্ত থেকে পুলিশ কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে, ‘ওইখানে মারামারি যা হয়েছে তো হইছে, ওই শালায় তো খারাপ। ওরা মারামারি করলে আমাদের লোকজনকে বলে দিয়েছি- রামদা লইয়া ওপেন শুড করতে। ফাইজলামি করলে কিন্তু সামনাসামনি কোপ খাইবে। আপনি কইয়া দেন যে সিদ্ধান্ত হইছে- মেয়র সামনে পড়লে মেয়রকেও কোপাইবো। যে সামনে পড়বে, হ্যারেই কোপাইবো; কেমন!’ তখন পুলিশ কর্মকর্তাকে ‘জি স্যার, জি স্যার’ বলতে শোনা যায়। বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, গত ৪ জুলাই রাতুল চৌধুরীকে কুপিয়ে জখম করার পর মেহেন্দীগঞ্জ শহরে দু’পক্ষ পাল্টাপাল্টি হামলার প্রস্তুতি নেয়। তখন রাত ৮টার দিকে এমপি পঙ্কজ পুলিশ কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামানের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে এসব কথা বলেন।
তৌহিদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, রাতুল চৌধুরীকে কু/পিয়ে আহত করার পর রাতেই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তখন এমপি তাঁকে ফোন করেছিলেন। কী বলেছেন, তা রেকর্ড না শুনে বলতে পারবেন না। কিন্তু এগুলো তাদের রাজনৈতিক বিষয়। পরিদর্শক তৌহিদুজ্জামান জানান, ভাইরাল হওয়া একটি অডিওর খবর তিনি শুনেছেন।
ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে আরও বলা হয়, ‘ঠিক আছে, যে কোপ খাইছে সে তো খারাপ, নেশাখোর, অ্যাডিকটেড- তাই না! আমি পোলাপানরে রেডি হইতে কইছি যে তোরা রেডি হ, যা থাকে কপালে, যুদ্ধ হইয়া যাক একটা।’ জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, স্যার।’
এ প্রসঙ্গে মেহেন্দিগঞ্জের মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন খান বলেন, ‘এমপি পঙ্কজ দেবনাথ ও মেহেন্দিগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তৌহিদুজ্জামানের মধ্যে এ কথা হয়। পুরো বিষয়টি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের জানিয়েছি।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, ‘পুরো কল রেকর্ড একাধিকবার শুনেছি। এক প্রান্ত থেকে রামদা দিয়ে কোপানোর নির্দেশদাতা হচ্ছেন এমপি পঙ্কজ দেবনাথ। তিনি দায়িত্বের জায়গা থেকে এসব বলতে পারেন না। এতে প্রমাণ হয় দলের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধা নেই, নেতা-কর্মীদের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। কণ্ঠস্বর নকল করা হয়েছে- সাংসদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তালুকদার ইউনুস বলেন, ‘পঙ্কজ দেবনাথ আবারও কণ্ঠস্বর অস্বীকার করে কাপুরুষতা দেখিয়েছেন।’
এদিকে সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ পুরো বিষয়টিকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দাবি করে বলেন, ‘যে নম্বর থেকে কল করা হয়েছে তা যাচাই না করেই কলটি তার বলে অভিযোগ করা গভীর ষড়যন্ত্র।’ তিনি বলেন, ‘তালুকদার ইউনুস ও কামাল খান ষড়যন্ত্র করছেন।’
এর আগে গত রমজানে উলানিয়ায় এক ইফতার পার্টিতে এমপি অংশ নিলে তার বিরোধিতাকারী একদল নারী ঝাড়ু মিছিল করে। ইফতার পূর্ব বক্তৃতায় এমপি পঙ্কজ দেবনাথ বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের নাম উল্লেখ করে গালিগালাজ করেন। এক বছর আগে আরেকটি অনুষ্ঠানে এমপি পঙ্কজ প্রয়াত প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর সমালোচনা করেন এবং তার জন্ম পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দুটি ঘটনাই সে সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
প্রসঙ্গত, মেয়রকে কপানোর কথা বলার ফোনালাপের বিষয়টি নিয়ে এমপি দাবি করেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ করা হলে তিনি আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।