২০১৭ সালের দিকের একটি ঘটনা, টাঙ্গাইল জেলার সখিপুরে প্রেমের টানে ছুটে এসেছিলেন জুলিজা বিনতে কামিস নামের মালয়েশিয়ার একজন তরুণী। এরপর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন টাঙ্গাইলের মনিরুল ইসলাম নামের এক যুবকের সাথে। বিয়ের ১৫ দিনের মধ্যে জানতে পারেন যে ওই তরুণীর মালয়েশিয়ায় নিজস্ব বাড়ি, সংসার এবং সন্তানও রয়েছে। এরপর মেয়েটি একসময় দেশে ফিরে যায় কিন্তু এই কয়েকদিনে মনিরুল এর পরিবার ওই তরুনীর পিছনে খরচ করে প্রায় ৮০,০০০ টাকার বেশি, যেটা অনেকটা ঋণ করেই মেটানো হয়।
ভিন্নচিত্রও আছে। এটি ২০১৭ সালের ঘটনা। প্রেমের টানে বাংলাদেশে এসে সুখেই আছেন ভিয়েতনামের নাগরিক টিউ থিতু। দিব্যি সংসার করছেন। যার টানে এসেছেন এই দেশে তিনি এখন প্রবাসী। টিউ এখন বাংলা বলতে শিখেছেন। তার মতে, বাংলাদেশ অনেক সুন্দর। এছাড়াও তার পরিবার এবং প্রতিবেশীরা খুব ভাল। তবে তিনি বলেন, বাঙালি পরিবারের সদস্য হলেও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি।
প্রেমের টানে রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির জামালপুর বাজারের সঞ্জয়ের কাছে ছুটে এসেছিলেন ব্রাজিলের সাওপাউলোর তরুণী জেইসা ওলিভেরিয়া সিলভার। বিয়ের পর চার দিনের সংসার জীবন ছিল তাদের। ব্রাজিলে ফিরে যাওয়ার পর সঞ্জয়ের সঙ্গে আরও কোনও যোগাযোগই রাখেননি সিলভা।
২০১৬ সালের পর থেকে হঠাৎই গণমাধ্যমে প্রায়শই দেখা যায়-প্রেমের টানে আসছেন তরুণ-তরুণীরা। একের পর এক এমন ঘটনায় জনমনে প্রশ্ন জাগে, কেন তারা মফস্বল শহরে ছুটে আসছেন? এ ধরনের ঘটনার পরিণতি খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে, তাদের অনেকেই দেশে ফিরেছেন। বেশিরভাগই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কেউ কেউ বিয়ে করে বরের সঙ্গে ফিরেছেন। তারা বিদেশে কেমন করছে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।
পরিচয় অধিকাংশই বিদেশের
পাভেল (২৭) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের জংগালী গ্রামের লিয়াকত হোসেনের ছেলে।২০১৪ সালে চাকরির জন্য সিঙ্গাপুরে যান। সেখানে ফাতেমা নামে এক তরুণীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পাঁচ বছর পর দেশে ফিরেছেন পাভেল। পাভেলের প্রেমের কারণে ওই তরুণীও কুমারখালীতে চলে যায়। গ্রামে ধুমধাম করে বিয়ে করেন পাভেল-ফাতেমার। এরপর প্রেমের গল্প বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র ২৬ দিনের জন্য পরিবার ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে যান ফাতেমা। পাভেলের কাছে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া রোগের কারণে তিনি ফিরতে পারেননি। পরে ফাতেমা তার স্বামীকে নতুন জীবন শুরু করতে বলেন।
ফাতেমার মতো অনেকগুলো ঘটনায় দেখা গেছে, প্রবাসে কাজ নিয়ে যাওয়ার পরে পরিচয় এবং কোনও কারণে দেশে ফিরে এলে তাদের জন্য বাংলাদেশে আসেন বিদেশি নারীরা। কিন্তু এসে আর থাকতে না পেরে ফিরে গেছেন।
তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে
সেলফোনের যুগে, পুরো বিশ্ব এখন আপনার হাতের মুঠোয়। যে কেউ আপনাকে ফেসবুকে নক করতে পারে। বিদেশ থেকে ফেরার পর সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি ফেস’বুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। প্রথমত, বিয়ে করে সহজে বিদেশ যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে এবং ‘উপমহাদেশের বাইরে নারীরা সহজে খারাপ কাজের সম্পর্ক স্থাপন করে’ এই ভুল ধারণা থেকে। ভুক্তভোগী একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানতে পারা গেছে, তাদের মধ্যে ভাষাগত সমস্যা রয়েছে। গুগল ট্রান্সলেট কীভাবে ব্যবহার করতে হয় তা শিখে অনেকেই কথোপকথনকে এগিয়ে নিয়েছেন। তাদের একাকীত্বের কথা শুনে মনে হয়নি কোনোভাবে বিয়ের পর চলে যাবে। অনেক বাংলাদেশি স্বীকার করেছেন যে তারা তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে তাদের প্রেমিকদের জানাননি।
সতর্কতা প্রয়োজন
চাঁদপুর সদরের ২নং আশিকাটি ইউনিয়নের শাহাদাত হোসেন বিদেশি নাগরিকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর তা টেকেনি। জুন মাসে মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর ১৫ দিনের মতো দেশে ছিলেন জিইনাবচন। এরপর আর যোগাযোগ নেই বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। এ ধরনের ঘটনায় সামাজিক অবমাননার শিকার হয়ে আরও অন্তত চারজন মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের প্রত্যেকে জানিয়েছেন, বিদেশি নাগরিক আসায় সংবাদ হয়েছে, পুরো গ্রাম দেখতে এসেছে আমাদের। এরপর ফিরে যাওয়ায় নানা হয়রানির শিকার হতে হয় তাদের।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পর্ক গড়তে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। এসব সম্পর্কের মধ্যে ভাষাগত বাধা, সাংস্কৃতিক বাধা রয়েছে।
যেহেতু দূরের দূর দেশের মানুষের সাথে পরিচিতি গড়ে ওঠার পর একসময় সম্পর্ক স্থাপিত হয়, সেহেতু তারা বাংলাদেশের মফস্বল এলাকার জীবন জাপান সম্পর্কে তাদের কোন ধারনাই থাকে না। তাই তারা যখন এদেশে প্রেমের টানে আসে তখন তারা স্বাভাবিকভাবেই আর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারেন না এবং যার কারণে কয়েকদিনের মধ্যেই সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরে কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।