তিনি শুধু তরুণ জুলহাসের প্রেমের কারণে বাংলাদেশে রয়ে জাননি। তিনি একজন বিদেশি নাগরিক হওয়া সত্বেও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখিয়েছেন এবং তার মনে সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য ভালোবাসা। তাই তিনি আর বাংলাদেশ ছেড়ে নিজের দেশে ফিরে যাননি। তিনি চেয়েছেন এদেশের মানুষের সেবা করতে। তাই এবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে নির্বাচনে বিজয়ী করে জনগনের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন।
বলছিলাম জীন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকার কথা, যিনি প্রেমের টানে ফিলিপাইন থেকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় এসে জুলহাসের সঙ্গে থিতু হন। যিনি ১০ বছর পর স্থানীয় ইউপি সদস্যও হন।
জীন কাটমাইন ওরফে জেসমিন আক্তার এরই মধ্যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে ছয় মাস পার করেছেন। এই প্রতিবেদক রাধাকানাই ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখতে যান তিনি এখন কেমন আছেন, জনগণের সেবায় কী করছেন বা তাদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া কেমন চলছে এসব খোঁজ খবর নিতে।
পরিষদের বারান্দায় পেট্রিয়াকারের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি একটি বেঞ্চে বসে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখছিলেন এবং তাতে স্বাক্ষর করছিলেন। ভাষার সমস্যার কারণে কিছু বুঝতে না পারলে সহকর্মীদের সাহায্য নেন। এভাবেই চলছিল তার কাজ।
এদিকে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন জিন কাটমাইন পেট্রিয়াকা। তিনি বলেন, ভালো আছেন। তিনি খুব ব্যস্ত। তবে ভাষার সমস্যার কারণে বিভিন্ন কাজে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। তবে তিনি নিয়মিত বাংলা শিখছেন।
পেট্রিয়াকা বলেন, আগে শুধু গৃহিণী ছিলাম, এখন জনপ্রতিনিধি হয়েছি। দুটি দায়িত্বই ভালোভাবে পালন করার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে টিআরের কাজ করেছি। এছাড়াও ইউনিয়ন পরিষদের সময় ছাড়াও এলাকার লোকজন যখনই আমার বাড়িতে যায় আমি তাদের জন্য কাজ করি।
পেট্রিয়াকা তার স্বামী জুলহাস উদ্দিনকে সবসময় তার সব কাজে পাশে রাখতেন। জুলহাস উদ্দিন বলেন, আগে শুধু গৃহিণী ছিল, ঝামেলা কম ছিল, এখন জনপ্রতিনিধি আছে, তাই চাপ একটু বেড়েছে। পরিশ্রম অনেক বেড়েছে, তবুও তিনি সর্বদা মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। জনগণের চাপে তিনি কখনোই অসন্তুষ্ট নন। বিভিন্ন সালিশি বৈঠকে যোগ দিতে বা বিভিন্ন নথিতে স্বাক্ষর করতে বিরক্ত করে না।
তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষেত্রে তিনি বাংলা কথা ও লেখা বোঝেন না। তারপর আমি তাকে সাহায্য করি এবং তাকে বুঝিয়ে বলি। তিনি কি বলছেন তা অন্যদের বলেন। এভাবে তার পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি।
সহকর্মীরা জানান, পেট্রিয়াকা সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করছেন। আর প্রয়োজনে এলাকার মানুষ সবসময় তাকে পাশে রেখেছেন। ইউপিতে নতুন সদস্য হওয়ায় এলাকার মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ পাচ্ছেন। অফিস টাইম শেষে বাসায় গেলেও কাজ মিটিয়ে দেন। তিনি ইউপি সদস্য হিসেবে উপযুক্ত।
ভাষার সমস্যা থাকলেও কাজের প্রতি পেট্রিয়াকার চেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো কমতি নেই বলে জানান রাধাকানাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া শিমুল তরফদার।
তিনি বলেছিলেন যে তিনি (পেট্রিয়াকা) কয়েকটি জিনিস করেছেন, ভাল করেছেন। কিন্তু আমাদের সমাজে সাধারণত মহিলা ইউপি সদস্যরা স্বামী দ্বারা পরিচালিত হয়। এই ক্ষেত্রে, যেহেতু তার ভাষার সমস্যা রয়েছে, তাই তিনি তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে কাজগুলি করেন। আর আমরাও তাকে যেকোনো কাজে সাহায্য করি।
জানা যায়, গত ছয় মাসে স্থানীয় কুদালিয়া পাড় ও চৌরঙ্গীপাড় এলাকায় দুটি সড়কে দুই লাখ টাকা ব্যয়ে মাটি দেওয়ার কাজ করেছেন পেট্রিয়াকা। এছাড়াও তিনি ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে ১৯০ জনকে ১০ কেজি চাল এবং ১০ জনকে টিসিবি কার্ড দেন।
জিন ক্যাটামিন পেট্রিয়াকা ফিলিপাইনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিশারিজ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্নাতক শেষ করার পর সিঙ্গাপুরে কর্মরত অবস্থায় তরুণ বাংলাদেশি জুলহাস উদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রেম, তারপর বিয়ে। আর ভালোবাসার টানে তিনি ১১ বছর আগে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন।
পরিবারের বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাধাকানাই ইউনিয়নের অজপাড়া গ্রামে। এখানেই শেষ নয়, ২০২১ সালের ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য পদে প্রার্থী হয়ে সবাইকে অবাক করে। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের দ্বিগুণেরও বেশি ভোটে নির্বাচিত হন।
সেখানকার বাসিন্দারা এই জনপ্রতিনিধি সম্পর্কে জানান, তিনি যা করছেন সেটা গ্রামের মানুষের জন্য অনেক আশাব্যঞ্জক এবং তিনি আন্তরিকতা দিয়ে সকলের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি একজন নারী নেত্রী হয়ে বাংলাদেশ থেকে গেছেন, এটা এ পর্যন্ত খুব কমই দেখা গেছে। তবে তিনি ভবিষ্যতেও নির্বাচিত হবেন এমনটাই আশা করছেন তারা।