জীবন সংগ্রামের জন্য অনেকেই প্রবাসে জীবনযাপন করে। তবে সবার জীবনে সুখ হয় এ বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে কেউ বলতে পারেনা। অর্থসংকটে ও ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমায়। অনেকে সাফল্য অর্জন করলেও ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হয় অনেকের। বিশেষ করে যারা দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশ যাত্রা করে তাদের অনেকেরই হয় করুণ পরিণতি। সম্প্রতি একটি হৃদয় বিদায়ক ঘটনা প্রকাশ করে কুয়েত প্রবাসী এক যুবক।
তিনি জানান, প্রবাস জীবন শুরু ২৪ বছর বয়সে। বিদেশে প্রতি রাতে কেঁদেছি। ঋণের বোঝা বহন করতে করতে আমি ক্লান্ত। আমার একমাত্র ছেলেকে হাফেজ বানাতে চাইলেও তার লেখাপড়া শেষ করতে পারিনি। আমি খুব অল্প বয়স থেকেই সংগ্রাম করে বড় হয়েছি। এমন কোনো কাজ ছিল না যা আমি করিনি। দেশের মানুষের কাছে আমার জীবনের দুঃখের গল্প বলতে চাই।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোট থানার কুয়েত প্রবাসী শাহ জামাল রিপন। ২০১১ সালের শুরুতে পারিবারিক সুখের আশায় তিন লাখ টাকায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুবাইতে উড়ে যান তিনি।
মাত্র ১৭ হাজার টাকা বেতনে একটি ক্লিনিং কোম্পানিতে কাজ করেন। যেখানে পুরো ৩ লাখ টাকা সুদে নেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতি মাসে তাকে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়েছে। আর এই টাকা জোগাড় করতেই তিনি বিদেশে যাবতীয় কাজ করেছেন।
শাহ জামাল বলেন, এভাবে সংসার চালানো যায় না। একদিকে সংসারের খরচ, অন্যদিকে মোটা অঙ্কের সুদে ঋণ। কাজের পাশাপাশি একসময় সিডি, ক্যাসেট ও পানীয় বিক্রি শুরু করি। ২ বছর পর, কোম্পানি আমাকে সহ ৪৭ জনকে লাইফ গার্ড প্রশিক্ষণে পাঠায়। সেই প্রশিক্ষণ কতটা কঠিন তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমিই একমাত্র পাশ করি। এই প্রশিক্ষণের সময় আমাকে কত সুইমিং পুলের জল পান করতে হয়েছিল তা কেবল আমিই জানি। আমি সফল হতে হবে. এরপর বেতন কিছুটা বেড়ে হয় ৩০ হাজার।
ততদিনে ঋণ বেড়েছে চার লাখ টাকা। ঋণের চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারিনি। এবার ডিউটির পাশাপাশি গাড়ি ধোয়া শুরু করলাম। দিনরাত পরিশ্রমের ফলে, কয়েক বছর পর ২০১৭ সালে ঋণ অনেক কমে যায়। ঠিক তখনই আমি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যাই।
তিনি বলেন, ২০১৭ সালের শেষের দিকে আমার দুই পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়। ফলে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশে যেতে বাধ্য হলাম। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির সহায়তায় দুই পায়েই অপারেশন করা হয় ঢাকার এভারকেয়ার (তৎকালীন অ্যাপোলো) হাসপাতালে। আমি সুস্থ হওয়ার 4 মাস পর আবার দুবাই ফিরে আসি।
দেশে গিয়ে আবার ঋণ বেড়ে গেল। আমি আমার আগের চাকরি পাইনি। গাড়ি ধোয়ার ব্যবসা করে যে ব্যবসা করতাম তাও বন্ধ হয়ে গেছে। কোম্পানির অনুমতি নিয়ে খাবারের ব্যবসা শুরু করি। আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি।
এদিকে দেশে থাকার জন্য ঋণ নিয়ে ৫ লাখ টাকা দিয়ে একটি জায়গা কিনেছি। আমি আরও কয়েকজনের সাথে আরবির ভিলায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে খাবারের ব্যবসা করছিলাম, হঠাৎ একদিন রাত 2 টার দিকে পুলিশের হামলা হয়। সেখানে আমরা প্রায় ৫০ জন ছিলাম। সবাইকে নিয়ে যায়। সব কাগজপত্র থাকার পরও তারা আমাকে দেশে পাঠিয়েছে। বলছিলেন শাহ জামাল।
তিনি বলেন, দেশে ফেরার পর তিনি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলেন। একদিকে ঋণের বোঝা, অন্যদিকে সংসার চালানো কঠিন। যে ছেলে কোরআনের হাফেজ হতে চেয়েছিল তাকে পড়ালেখা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন আর ফোন ধরে না। বিদেশে গিয়ে যারা খবর শুনতেন তারা এখন আর খবর শোনে না।
আপনার বোধগম্য হল ভালো সময়ে সবাই আপনার পাশে থাকে, কিন্তু খারাপ সময়ে কেউ আপনার পাশে থাকে না। তার ভাই এবং ভাগ্নের সহায়তায় তিনি তার গ্রামে একটি ছোট রেস্তোরাঁ খোলেন। যেখানে শাহ জামাল নিজেকে কারিগর এবং তার ছেলেকে মেসেয়ার হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন।
শাহ জামাল বলেন, আমি যে ছেলেটির স্বপ্ন দেখতাম তার স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে এত অল্প বয়সে তাকে আমার সঙ্গে কাজ করিয়ে দিয়েছি। করোনার কারণে রেস্টুরেন্টটি কাজ করছিল না। আমার সুদসহ ঋণ বেড়ে ১০ লাখ টাকার ওপরে দাঁড়িয়েছে। দোকানের আয় দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতাম। আমার অকাল স্ত্রী সবসময় আমার পাশে ছিল।
“এত দারিদ্র থাকা সত্ত্বেও কখনো বাজে কথা বলেনি। তখন শাশুড়ির কাছ থেকে অনেক আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছি। এক বছর দুই মাস পর যখন আর পারলাম না, তখন মেজ ভাই। আমাকে কুয়েতে নিয়ে এলো।ভিসার খরচের কারণে লোন বেড়েছে পাঁচ লাখ।আমি আবার ক্লিনিং কোম্পানিতে কাজ শুরু করেছি।বেতন এখন ২১ হাজার টাকা।
অনেক সময় কারো কাছ থেকে সাহায্য না পেলেও আমার মেজ ভাইয়ের সাহায্য পেয়েছি। তার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। কুয়েতে আসার পর নিজের সাথে যুদ্ধ করছি। ভাই সবসময় ভরসা রাখেন।
আমি এখন যে কোম্পানিতে আছি তার অবস্থা তেমন ভালো নয়। আমি আমার কোম্পানির দায়িত্ব ছাড়াও একটি খণ্ডকালীন চাকরি করছি। ১৫ লাখ টাকা ঋণ যা আমাকে শোধ করতে হবে। যার বেশির ভাগই সুদের ওপর। আমি আমার পরিবারকে বলেছি, ঋণ পরিশোধের আগে আমি মরে গেলে আমার লাশ যেন দেশে না যায়,” যোগ করেন শাহ জামাল।
কি কঠিন প্রবাস জীবন! প্রবাসী শাহ জামাল ১১ বছর ধরে ঋণের বোঝা। আগ্রহের টানেই যেন তার জীবন শেষ। দিনরাত পরিশ্রম করেও তার কোন ধার নেই। আপনি যখন মনে করেন যে আপনি আপনার জীবন একটু স্বাচ্ছন্দ্যে পার করবেন, তখন অন্য বিপদ আসে।
ঋণ যতক্ষণ মানুষের ঘাড়ে থাকে, ততক্ষণ সে শোধ না করা পর্যন্ত শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। আর এর শিকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রবাসীরা। যার ফলে আমরা প্রবাসীদের লাশ পাই। এই ঋণের ভারে অনেক প্রবাসী স্ট্রোক করে মারা যায়। কেউ কেউ আ/ ত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
অনেক অসাধু লোক রয়েছে যারা সুদের লোভে মানুষকে সাহায্যের নামে টাকা ঋণ দিয়ে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। অনেকে তাদের কবল থেকে বেঁচে বেরোতে পারলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে দরিদ্র ব্যক্তিদের। আসল টাকা শোধ না দিতে পারে সুদের হার বাড়তে থাকে নিয়মিত। একপর্যায়ে আসল টাকা থেকে সুদের টাকা হয়ে যায় অনেক বেশি আর সেই সুদের টাকা থেকে তৈরি হয় আরো বেশি সুদ। এভাবে নিয়মিত শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক হতদরিদ্র মানুষের জীবন। কেউতো আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এমন ঘটনার অনেক দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে রয়েছে।