সম্প্রতি কিছুদিন আগেও ক্ষমতাসীন সরকারের অন্যতম একটি পদে ছিলেন ডা. মুরাদ হাসান। কিন্তু এখন আর সেই পদে নেই তিনি। অনেকের মতে, নিজের দোষেই নাকি আজ তার এই অবস্থা। তবে যাই হোক না কেন, তাদের কথা কিন্তু একেবারে ফেলে দেয়া যায় না। একের পর এক বিতর্কিত কাণ্ড ঘটিয়েছেন তিনি। আর অবশেষে সেই বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জের ধরেই পদ হারাতে হলো তাকে।
এদিকে এবার জানা গেল, সদ্য পদত্যাগকারী তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডাক্তার মুরাদ হাসান জামালপুরের সরিষাবাড়ির মাঠের কোনো নেতা বা কর্মী ছিলেন না। জেলা শহরে বসাবাসের ফলে নিজ গ্রাম আওনা ইউনিয়নের দৌলতুপুর তালুকদার বাড়িতে খুব একটা যাননি। তবে তার বাবা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারের নিজস্ব বলয় ও কর্মী বাহিনী ছিল।
৯০ দশকের পর সরিষাবাড়িতে মূল আওয়ামী লীগ দুটি বিভাগে বিভক্ত। ১৯৯৬ সালে মুরাদ হাসানের বাবা অ্যাডভোকেট মতিয়র রহমান তালুকদারকে নমিনেশন না দিলেও তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদারকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হন মরহুম সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মাওলানা নূরুল ইসলাম।
এমপি নির্বাচিত হবার পর কোণঠাসা হয়ে পড়ে অপর গ্রুপের নেতাকর্মীরা। এ অবস্থায় ১৯৯৮ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যা শেষে অসহায় ও দুঃস্থ মানুষকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নামে নিজ এলাকা জগন্নাথগঞ্জ পুরাতন ঘাট বাজারে ফি চিকিৎসা ক্যাম্পের মাধ্যমে তার এলাকায় পদার্পণ ঘটে। ডাক্তার মুরাদ হাসান নিজ এলাকায় নতুন হবার ফলে বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল হোসেনের হাত ধরে পরিচিত হন।
এরপর থেকেই সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। এ অবস্থায় ২০০১ সালে নির্বাচনে ডাক্তার মুরাদ হাসানসহ (বড় খ্যাত আবুল হোসেন) নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করান বড় ভাই আবুল হোসেনকে। ডাক্তার মুরাদ হাসান ছিলেন তার প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট। নির্বাচনের পর দীর্ঘদিন ছিলেন এলাকা ছাড়া। কিন্তু হঠাৎ ২০০৭ সালে আবারো এলাকায় আসেন তিনি। বাবার যোগ্যতায় ৩৪ বছর বয়সে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন।
এমপি হয়েই দলের মধ্যে গ্রপিং তৈরি করেন। আধিপত্য বিস্তার করতে একটি ক্যাডার বাহিনীও গঠন করেন। ওই সময় তার ক্যাডার বাহিনীর তাণ্ডবে সরিষাবাড়িতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। নিজের মতো সব চালাতে থাকেন। নির্বাচনে এমপি হলে বড় ভাই আবুল হোসেনের নেতৃত্বেই চলেন মুরাদ হাসান। তিনি আস্তে আস্তে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। তার কর্মী বাহিনীরও একই অবস্থায়। আস্তে আস্তে তার দলে সংখ্যা বাড়তে থাকে।
তার এ মাদকাসক্তের ব্যাপার উপজেলাবাসী জানলেও কেউ টু শব্দটি করতে পারতো না। এসব কর্মকাণ্ডের বিষয় প্রতিবাদ করলে তাকে লাঞ্ছিতও করতেন। তাছাড়া এমপি হিসেবে নানা অপকর্মের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন নিজ দলের কর্মীদের।
কামারাবাদ এলাকায় ভুক্তভোগী খোরশেদ অভিযোগ করেন, তারা পৈতৃক ৫০ শতাংশ জমি অর্থের বিনিময়ে পাইয়ে দেন লুৎফর রহমানকে। তিনি বলেন, ঐ জমির মালিকানা নিয়ে পারিবারিক ঝামেলা চলছে। এ সুযোগে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা নিয়ে জায়গাটা দিয়ে দেয়। তাকে দুপুরে থানায় নিয়ে যায়। আটকিয়ে রাখা হয়। মামলা দেওয়া হয়। তার এ জায়গায় গোডাউন ছিল এখন ব্যবসাও বন্ধ। দলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি, নির্যাতনের বহু অভিযোগ রয়েছে ডাক্তার মুরাদের বিরুদ্ধে।
উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আল আমিন হোসেন শিবলু বলেন, তাকে মুরাদের ক্যাডার বাহিনী অত্যাচার করে। সাধারণ সম্পাদককে গুলি করে একটি চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। ২০১৯ সালে আমাদের নির্যাতন করে।
তিনি বলেন, অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা এলাকায় থাকতে পারে না। একটা ক্যাডার বাহিনী গঠন করছে যা দিয়ে নির্যাতন চালায়। থানা শ্রমিক লীগের জয়েন্ট সেক্রেটারিকে ২ বছর আগে মারে। তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে।
ছাত্রলীগ সভাপতি শিবলু বলেন, আমার নামেও মামলা হয়েছিল। মারামারির মামলা করে। মামলায় আমাকে এক নম্বর ও আমার বাবাকে ৩ নম্বর আসামি করা হয়। ২১ জনের নামে মামলা হয়। তার বাবা ব্রংকাইটিসের রোগী। আমার বাবাকে অ্যারেস্ট করে থানায় না রেখে চালান করে। আমাকেসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। কলেজের ছাত্র সংসদের মনোনয়ন গেছে এমপির ডিও লেটারে। রাশেদ মোশারফ নামে এক ছাত্রনেতাকে বেদম পেটায়। ভিপি নাজমুল হুদা জিএস রাজন এজিএস সুমন তাকে বেদম পেটায়। অসংখ্য ছাত্রনেতার ওপর হামলা হয়।
এদিকে এলাকাবাসীর অভিযোগ, ডাক্তার মুরাদের অপকর্মের সহযোগী ছিলেন সাখাওয়াত হোসেন মুকুল। এলাকায় তিনি ডাক্তার মুরাদের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। সরিষাবাড়ি পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। মুকুলের এলাকায় ২০-৩০ জনের একটা সন্ত্রাসী দল আছে। যারা প্রত্যেকেই এলাকায় ত্রাস। মুকুলের কথায় তারা যে কোনো কাজ করতে পারে। মুরাদ এলাকায় এলে তারা প্রটোকল দেয়। মুরাদ বাহিনী যমুনা সার কারখানার বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে অর্থ আদায় করতো। তার গড়া সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ লুট করেছে। প্রতিমন্ত্রী ও দলীয় পদ হারানোর পর গা-ঢাকা দিয়েছেন মুকুল ও তার সহযোগীরা।
প্রতিমন্ত্রী এবং দলীয় পদ হারানোর পর নিজ নির্বাচনী এলাকায়ও চরম বেকায়দায় ডা. মুরাদ হাসান। তার কাছে জিম্মি হয়ে থাকা নেতাকর্মীরাই এখন তার সব কুকর্মের ফিরিস্তি দিচ্ছেন। তারা বলছেন, মুরাদ সরিষাবাড়ীতে দলীয় নেতাকর্মীদের জিম্মি করে রেখেছিলেন। তার বিরুদ্ধে কথা বলা তো দূরের কথা অকারণেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাদের। এখন এ নেতাকর্মীরাই সোচ্চার মুরাদের নানা অপকর্ম নিয়ে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ হারুনুর রশিদ বলেন, উপজেলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল মুরাদ। সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছে। তার ইঙ্গিতে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগ ছিল না। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। আমাদের নেতাকর্মীদের যেসব ভাষায় গালি দিতেন তিনি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তিনি নেশাগ্রস্ত হয়ে পার্টি অফিসে আসতেন। কারো কথা শুনতেন না।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছানোয়ার হোসেন বাদশার বলেন, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে মুরাদকে সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্তভাবে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের কাছে পাঠানো হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত এলে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইভে শহীদ জিয়া ও জাইমা রহমানকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য, এবং মাহিয়া মাহির সঙ্গে একটি ফোনালাপ প্রকশ্যে আসতেই নানা বেশ সমালোচনায় জড়িয়ে পড়েন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। এরপর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।