প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে ১৫ বছর ধরে পিঠে ধরে সংসার চালানো সোহেল মিয়া-রওশন আক্তার দম্পতির ভালোবাসার গল্প সম্প্রতি আলোচনায় আসার পর থেকে তা স্পর্শ করেছিলো এদেশের হাজারো মানুষের মন৷ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে তাঁদের গল্প নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও যোগাযোগ করা হয়। এমনকি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় একটি বাড়ি তৈরী করে দেয়ারও।
মানুষ যখন মুদ্রার একটি পিঠ দেখে সোহেলের তারিফে মেতে উঠে, তখনি সোহেলের আগের বিয়ের কথা সামনে আসে। শুধু তাই নয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকে শুরু করে নানা বিষয়েই মিথ্যা কথা বলেছিলেন সোহেল! আর তাতেই পাল্টে গেছে পরিস্থিতি। সেটি এতটাই বেগতিক যে সাহায্য, স্বীকৃতির বদলে এখন সংসার টেকানোর অনুরোধ সোহেলের স্ত্রী রওশনের। গণমাধ্যমের কাছে অনুরোধ, ‘দয়া করে আমার সুন্দর সংসারটা আপনারা ভাঙবেন না’।
১০ টাকার একটি নোটে পাওয়া নম্বর থেকেই শুরু হয় তাদের প্রেম। ২০০৭ সালে পরিবারের অমতে বিয়ে করেন রওশন ও সোহেল। এরপর একে একে কেটে গেছে ১৫টি বছর। তাদের ভালোবাসার ছোট্ট ঘর আলো করে এসেছে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানও।
তাদের অদম্য এই ভালোবাসার গল্প গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে প্রকাশ করে । এরপরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশ পেয়ে সোহেল-রওশনের ভালোবাসার গল্প শুনতে ও তাদের জীবনযাপনের সমস্যা দেখে আসতে সরেজমিন তাদের বাড়ি যান ত্রিশালের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আক্তারুজ্জামান। তিনি তাদের থাকার ঘর, জীবিকা নির্বাহের জন্য দোকান ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা করে দেয়ার আশ্বাস দেন। তবে এরই মধ্যে বেরিয়ে এসেছে ১৬ বছর আগে করা সোহেলের বিয়ের কথা।
জানা গেছে, আগেও বিয়ে করেছেন সোহেলের। ওই নারীর নাম শুরাতন বেগম। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার বাঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামে। এনিয়ে এলাকায় এখন সমালোচনার ঝড় বইছে। তিনি দাবি করেন, সোহেল মিয়া নাম বলা হলেও তার স্বামীর নাম মোখলেসুর রহমান, ডাক নাম বকুল। একই ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামের বকুলের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৯২ সালে। এরপর ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে ঢাকা যাওয়ার কথা বলে, তার স্বামী আর ফিরেনি। ওই সময় তিনি অনেক খোঁজখবর নিয়েও তার কোনো সন্ধান পাননি। শুরাতন বেগম জানান, তার তিন ছেলে এক মেয়ে। ছেলে মেয়েদের নিয়েই তিনি এরপর অনেক কষ্টে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এখন আর স্বামীকে ফিরিয়ে নিতে চান না। তবে তিনি আরও জানান, সোহেল মিথ্যা কথা বলছে, এটা সবাই জানুক।
শুরাতন বেগমের বড় ছেলে, সিহাব উদ্দিন জানান, তার বাবাকে ফেসবুক, টিভিতে দেখে চিনতে পেরেছেন। তিনি বলেন এতোদিন জানতাম বাবা নিখোঁজ। কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন উনিই আপনার বাবা? এমন প্রশ্নে সিহাব বলেন, নিজের বাবাকে দেখে চিনব না? গ্রামের সবাই চিনতে পেরেছে। সিহাব উদ্দিন আরও বলেন, তার বাবা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন, কিন্তু বলছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলে সত্য বেরিয়ে আসবে। তার আসল নাম মোখলেসুর রহমান বকুল। কিভাবে সোহেল মিয়া হলেন, আইডি কার্ড কিভাবে করল এ বিষয়গুলো দেখতে বলেন তিনি। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়, ছোট ভাই সোহাগকে নিয়ে একটি চায়ের দোকান চালান তিনি। সেই আয় দিয়ে মাকে নিয়ে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। সবার ছোট নিরব অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। একমাত্র বোনের বিয়ে দিয়েছেন। বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর, খোঁজ করেছিলেন কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ঢাকায় খুঁজে বের করার মত সামর্থ্য হয়নি তাদের।
এদিকে এ ঘটনায় হঠাৎই চেনাজানার জগতে ভীষণ বদলে গেছে রওশনের। প্রতিবন্ধী রওশন বলেন, ‘সোহেলের আগের বিয়ে নিয়ে আমি কিছুই জানতাম না। তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথাও নেই। তবে আমার সংসার এখন ভাঙার পথে।’
রওশন আরও বলেন, ‘তিনি আমাকে ভালোবাসেন, এটি মিথ্যা নয়। ১৫টি বছর ধরে আমার মতো অসুস্থ একজনের সাথে সংসার করছেন তিনি। আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে তাকে জয় করেছি। তিনি হাত জোড় করে বলেন, আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমার সংসারটি কেউ ভাঙবেন না। আমি একজন প্রতিবন্ধী, আপনাদের মতো আমি সুস্থ নই। আমার স্বামী প্রতারক কিনা তা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা নেই।’
সোহেলের আগের স্ত্রীর সঙ্গে তিনি একসাথে থাকতে রাজি জানিয়ে রওশন বলেন, ‘তিনি যদি চান আমরা একসাথে সবাই মিলে থাকতে পারি। কিন্তু এই ১৫-১৬ বছর ধরে তার কোনো খোঁজ নেননি তারা, জিডিও করেননি। এখন প্রধানমন্ত্রী আমাদের একটি থাকার ঘর দিচ্ছে বলেই এসব কথা বলে বেড়াচ্ছেন?’ সংবাদমাধ্যম কর্মীদের কাছেও বিষয়টি নিয়ে আর কিছু না প্রকাশ করার অনুরোধ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, শারীরিক অসমর্থতার পরও সোহেলের কাছ থেকে কখনো ভালোবাসার কমতি দেখেননি জানিয়ে স্বামীকে নিজের ভক্ত বলে মন্তব্য করেন রওশন। এছাড়াও তাঁদের সংসার চিরজীবন অটুট থাকার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।