বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে পেগাসাস আতঙ্ক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন মানুষ সচেতন হচ্ছে এই বিষয়টি নিয়ে দেখা গেছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এই পেগাসাস কাণ্ড নিয়ে ব্যাপক তুলকালাম হয়েছে। এই পেগাসাস আতঙ্কের কারণে দেখা গিয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো তার মোবাইল ফোন পরিবর্তন করে নিয়েছেন এবং বিশ্ব নেতারা এটি নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বটে তবে তারা সচেতন থাকার চেষ্টা করছেন
ইন্টারনেট দুনিয়ায় এর থেকে বড় কেলেঙ্কারি আর আসেনি। তবু অনেক লোক এখনও বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে নেট দুনিয়ায়। কী এই পেগাসাস স্ক্যাম। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো তার মোবাইল পরিবর্তন করে ফেলেছেন। কারণ, এই কেলেঙ্কারিতে তার নাম উঠে এসেছে শিকার হিসেবে। বিশ্বের অনেক দেশে এখন এই পেগাসাস স্ক্যাম নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে এখনও পেগাসাস নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। সম্ভবত আমরা অনেকে বিগত কয়েক বছরে ফোন ফাঁসের ঘটনায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
এতটা অভ্যস্ত হয়েছি যে ফোন ফাঁস যেন কোনও ব্যাপারই না। যেমন এই মুহূর্তে রাজধানী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিন্সিপালের সঙ্গে এক অভিভাবকের ফোন ফাঁস নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা প্রিন্সিপাল ম্যাডাম একজন শিক্ষক হয়ে কীভাবে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছেন সেটা নিয়ে মজে আছি। কিন্তু সরল বিশ্বাসে তিনি একজন অভিভাবক নেতার সঙ্গে ফোনে আলাপ করছেন, সেই লোক সেটা রেকর্ড করে খণ্ডিত আকারে বাজারে ছেড়ে দিয়েছে এবং বাংলা ট্রিবিউনের রিপোর্টে দেখলাম গর্বভরে স্বীকারও করছেন। সেই লোকের কী সাজা হওয়া উচিত কেউ একবারও চিন্তা করছি না, উচ্চারণও করিনি। সোশ্যাল মিডিয়ার দুর্বলতা হচ্ছে এটিই– আপনাকে গড্ডালিকা প্রবাহে যেতে উদ্বুদ্ধ করবে, এককেন্দ্রিক চিন্তা করতে শেখাবে। এখানে সবাই ঘুরে ভাইরাল আর ট্রেন্ডের পেছনে।
ভারতে প্রতিদিন এখন শিরোনাম হিসেবে দখল করে আছে পেগাসাস কেলেঙ্কারি। কারণ, সেখানকার প্রায় ৩০০ সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, আমলা এবং রাজনীতিবিদের নাম উঠে এসেছে পেগাসাস কাণ্ডে। পেগাসাস দিয়ে এদের কারও ওপর গোয়েন্দাগিরি করা হয়েছে, কারও ওপর গোয়েন্দাগিরির চেষ্টা হয়েছে এবং কেউ কেউ সম্ভাব্য টার্গেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
এখন পরিষ্কার করা দরকার পেগাসাস কী। ‘পেগাসাস’ শব্দটা এসেছে গ্রিক মিথোলজি থেকে। সাদা রঙের ঘোড়া, যার পাখা আছে, তাকে ডাকা হয় পেগাসাস। কিন্তু নেট দুনিয়ায় আলোচিত আজকের পেগাসাস এসেছে একটি স্পাইওয়্যার হিসেবে। এটা এমন মারাত্মক একটি সফটওয়্যার, যেটা আপনার ফোনে যদি কেউ ভরে দিয়ে থাকে তাহলে আপনার ফোনে রাখা সব তথ্যভাণ্ডার চলে যাবে অন্যের হাতে। আপনার ফোনে ঢুকে কথা রেকর্ড করতে পারবে, জিপিএস ট্র্যাক করে আপনার লোকেশন জেনে নিতে পারবে, গোপনে আপনার ক্যামেরা অন করতে পারবে, মেসেজ পড়তে পারবে, হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ দেখতে পারবে, সব পাসওয়ার্ড জেনে নিতে পারবে। এক কথায় আপনার সবকিছুই চলে যাবে তার হাতে। সে কারণেই পেগাসাসকে বলা হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে খতরনাক সফটওয়্যার।
প্রশ্ন আসে পেগাসাস আপনার ফোনে আসবে কী করে? আপনার বাঁচার উপায় কী? আগে আমরা দেখতাম এ জাতীয় স্পাইওয়্যার ফোনে বা পিসিতে পাঠানো হতো ম্যাসেঞ্জার বা ইমেইলে কোনও লিংক পাঠিয়ে। সেখানে ক্লিক করলেই সক্রিয় হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর সেটা দরকার নেই। আপনার ফোন নম্বর জানা থাকলেই যথেষ্ট। আপনাকে একটা ফোন করবে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেবে। ফোন না ধরলেও এটা কাজ করবে। তাতেই সম্ভব পেগাসাস আপনার ফোনে সক্রিয় হয়ে যাওয়া। বাঁচতে পারবেন কীভাবে? বাঁচার উপায় নেই। যদি ফোন নম্বর একান্ত লোকদের দিয়ে থাকেন আর লোকেশন হাইড করার জন্য ভিপিএন ব্যবহার করে থাকেন- হালকা রক্ষা পাবেন। তবে গ্যারান্টি নেই।
এই পেগাসাস সফটওয়্যারটি বানিয়েছে একটি ইসরায়েলি কোম্পানি-এনএসও। যেটি তার তিন মালিকের নামের অদ্যক্ষর। কিনতে আনুমানিক ৪ কোটি টাকার মতো খরচ পড়বে, আর প্রতি ১০ জনের ফোনে ইনস্টল করতে ৫ কোটি করে গুনতে হতে পারে। প্রশ্ন আসে এমন সফটওয়্যার বানানোর কী দরকার ছিল? এনএসও দাবি করছে তারা পেগাসাস সৃষ্টি করেছে যাতে করে সরকারি গোয়েন্দা বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এটা ব্যবহার করে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করতে পারে। মেক্সিকো সরকার দাবি করছে যে তারা এই পেগাসাস ব্যবহার করে সেখানকার ড্রাগ লর্ড এল চাপোকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এই ধরনের স্পাইওয়্যার থাকলে দুনিয়াটা অনেক সুন্দর করা যেত।
কিন্তু আপনার ভাবনা ভুল। দুনিয়া কাঁপানো কোনও বড় টেরোরিস্টের নাম ফাঁস হওয়া তালিকায় পাবেন না। ভালো কাজের প্রযুক্তি ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি হয়- সেটি আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। যে মেক্সিকোর উদাহরণ দিলাম সেই মেক্সিকোর একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মেক্সিকো সরকার এটি ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ওই মেক্সিকান সাংবাদিক সরকারের কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস করে দিয়েছিল। এখানেই শেষ নয়। এরপর ওই সাংবাদিক হয়েছেন।
আবার দেখেন সৌদি নাগরিক ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট জামাল খাশোগি কাহিনিটাও ঘটেছিল এই পেগাসাস ব্যবহার করে। সৌদি যুবরাজ পেগাসাস ব্যবহার করেছেন জামাল খাশোগির হবু স্ত্রীর ফোনে, খাশোগির মৃত্যুর কয়েক দিন আগেই তার হবু স্ত্রীর ফোন হ্যাক করে এই স্পাইওয়্যার প্রবেশ করানো হয়েছিল। সে কারণেই তারা জামালের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলেন। সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আরও আগেও এসেছিল, তিনি অ্যামাজন চিফ জেফ বেজোসের ফোন হ্যাক করেছিলেন। এটাও পেগাসাস কাহিনি।
বর্তমান সময়ে পেগাসাস কলঙ্ক ফাঁসের কাজটি করেছে ফ্রান্সভিত্তিক একটি এনজিও ‘ফরবিডেন স্টোরিজ’। তারা টেকনিক্যাল সাপোর্ট নিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে। তারা ৫০ হাজার ফোন নম্বর তালিকাভুক্ত করে বলেছে যে এসব নম্বর সেসব সাংবাদিক, পলিটিক্যাল লিডার, আমলা এবং অ্যাকটিভিস্টসহ বিশ্বের নানা জনের, যাদের কারও কারও ফোনে পেগাসাস প্রবেশ করানো হয়েছে, হওয়ার চেষ্টা হয়েছে বা তারাই টার্গেট।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৭টি মিডিয়া প্রতিষ্ঠান কোলাবরেশনের মাধ্যমে এই লেটেস্ট ঘটনা ফাঁস হয় অতি সম্প্রতি। এসব মিডিয়ার মধ্যে রয়েছে রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, জার্মানির ডিসাইড, ফ্রান্সের লে মন্ডে, ইসরায়েলের হারেটজ, মেক্সিকোর প্রোকেসো, হাঙ্গেরির ডিরেক্ট থার্টিসিক্স। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এটি প্রকাশে সহায়তা করেছে এবং কানাডাভিত্তিক দ্য সিটিজেন ল্যাব স্বাধীন সংস্থা হিসেবে তা রিভিউ করে মতামত দিয়েছে, যে পদ্ধতিতে এই ইনভেস্টিগেশন হয়েছে, পেগাসাস স্পাইওয়্যার আইডেন্টিফাই করার ক্ষেত্রে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যে ফরেনসিক মেথড ব্যবহার করেছে, সেটা সঠিক ছিল। ফরবিডেন স্টোরিজ ১১টি দেশে এনএসও’র ক্লায়েন্টকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে।
এসব দেশের মধ্যে রয়েছে, সৌদি আরব, বাহারাইন, ইউএই, আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, টোগো, রুয়ান্ডা, মরক্কো, মেক্সিকো, হাঙ্গেরি ও ইন্ডিয়া। ডেমোক্র্যাসি ইনডেক্স অনুযায়ী এসব দেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি উন্নত নয় এবং সবচেয়ে উন্নত যে দেশটি এখানে আছে সেটি হচ্ছে ইন্ডিয়া। তার র্যাংকিং ৫৩ আর সবচেয়ে খারাপ সৌদি আরবের, তার র্যাংকিং ১৫৬। যে ৫০ হাজার লোককে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল তাদের মধ্য থেকে এক হাজারকে ইতোমধ্যে আইডেন্টিফাই করা হয়েছে এবং তাদের অনেকের ফোন ফরেনসিক এক্সামিনেশনের জন্য দেওয়া হয়েছিল এবং সবক’টিতেই পেগাসাসের অস্তিত্ব প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ভারতের ৩০০ জনের নাম এসেছে পেগাসাস লিস্টে। তার মধ্যে বিরোধী কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী থেকে শুরু করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সিবিআই প্রধান, প্রধান বিচারপতি, ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোরের নামও এসেছে। রাফায়েল কেলেঙ্কারিতে বিজেপি সরকারের নড়বড়ে অবস্থা ছিল। এই মামলার রায়ের আগে প্রধান বিচারপতির রঞ্জন গগৈর বিরুদ্ধে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ এনেছিল এক নারী। তার ফোনেও পেগাসাস দেওয়া হয়েছিল। রঞ্জন গগৈ ওই কেলেঙ্কারির কয়েক মাস পর রাফায়েল মামলায় বিজেপি সরকারকে ক্লিনচিট দিয়েছিল। তাহলে ভারতে পেগাসাস কেলেঙ্কারির পেছনে কে আছে সেটা স্পষ্ট ভারতীয়দের কাছে।
দৈনিক ভাস্কর পত্রিকা পেগাসাস নিয়ে একটা বড় প্রতিবেদন তৈরি করেছিল। ক’দিন পরে তাদের অফিসে ইনকাম ট্যাক্স কর্তারা হানা দিয়েছে। এই স্ক্যান্ডেলের ইনভেস্টিগেশন হওয়া উচিত বলে ভারতের স্বাধীন মিডিয়াগুলো মত প্রকাশ করছে কিন্তু সরকার এটাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছে। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তদন্ত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। হাঙ্গেরি, ইসরায়েল, ফ্রান্স তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে। মোদির সমর্থকরা প্রচার করছে যে উন্নয়নের গতি থামিয়ে দেওয়ার জন্য এটা মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। এই অন্ধদের বুঝাবে কে ‘তোদের’ উন্নয়নের গতি থামানোর ষড়যন্ত্রের কারণে তাহলে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকেও ফোন বদল করতে হচ্ছে!
মূলত পেগাসাস হচ্ছে একটা স্পাইওয়্যার সফটওয়্যার যা দিয়ে অন্যের মোবাইলে থাকা সমস্ত ডাটা এক্সেস করতে পারে এবং সবকিছু অন্যের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার কে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবথেকে মারাত্মক সফটওয়্যার এই সফটওয়্যারটি মূলত নিমিষেই ইন্সটল করা যায় অন্যের ফোনে শুধুমাত্র তার ফোন নাম্বারটা জানা থাকলে আগে যেভাবে দেখা যেত এ ধরনের স্পাইওয়্যার ইনস্টল করতে হয়তোবা কোন লিংক পাঠাতে হতো বা অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করতে হতো তবে এই স্পাইওয়্যার এগুলোর কোনোটি করা দরকার পড়ে না