আবুল হোসেন রাজন পেশায় একজন আইনজীবী সেই সাথে তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবেও কাজ করেন। তার সাথে একটি ভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছে তার পরিবারের সদস্যরা। গত ২২ জানুয়ারি তিনি প্রতিদিনের মতো করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হন। তার বাসা পুরান ঢাকায়। এরপর থেকে তাকে আর খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে রাজনকে অনেক খোজা খুজি করে তার পরিবার। তার পরিবারের সদস্যরা সম্ভাব্য সকল স্থানে তার খোঁজ নিতে থাকেন। কিন্তু কোথাও রাজনের হদিস মিলছিল না।
রাজনের বাবা ইসমাইল হোসেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, ২২ জানুয়ারি রাজনকে মগবাজারের আদ্দীন হাসপাতালের সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তার ছেলে হাতিরঝিল থানার হেফাজতে রয়েছে বলে জানা গেছে।
খবর পেয়ে গত ২৩ জানুয়ারি হাতিরঝিল থানায় যান রাজনের বাবা ইসমাইল হোসেন। সেখানে নিজের পরিচয় দিয়ে ছেলে রাজনের কথা জানতে চান তিনি। তবে, রাজন নামে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে থানা থেকে জানানো হয়। পরদিন অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি স্ত্রী শামীমা সুলতানা হাতিরঝিল থানায় যান। তাকে আরও জানানো হয়, ‘থানায় এই নামের কেউ নেই’। তারপর তিনি পুরান ঢাকার বাসায় চলে যান।
হাতিরঝিল থানায় কোনো খবর না পেয়ে রাজনের পরিবার হাল ছাড়েনি। হাতিরঝিল থানার সামনে একজনকে রাখা হয়েছে, যিনি রাজনের খোঁজখবর রাখেন। পুলিশের গতিবিধির ওপর নজর রাখেন। ওই ব্যক্তিও রাজনকে পুলিশের গাড়িতে করে থানা থেকে বের হতে দেখেছেন। এমন দাবি করেন রাজনের ছোট ভাই মহিউদ্দিন খান। শামীমাও একই দাবি করেছেন।
রাজনের বাবা ইসমাইল হোসেন, স্ত্রী শামীমা সুলতানা ও ভাই মহিউদ্দিন খান পুরো ঘটনাটি এনটিভি অনলাইনকে জানান। ইসমাইল হোসেন বলেন, আমি থানায় গিয়ে কথা বলেছি। পুলিশ জানিয়েছে, রাজনকে গ্রেফতার করা হয়নি।
শামীমা সুলতানা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘২৪ জানুয়ারি আমি থানায় যাই। পুলিশ বলছে, রাজন থানায় নেই। পরে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) নম্বরে ফোন করি। আমি তাকে বললাম, আমার স্বামী আপনার জিম্মায় আছে। আমি তার সাথে দেখা করতে চাই। তিনি বলেন, থানায় এই নামের কেউ নেই। তারপর লাইন কেটে দেন।
শামীমা সুলতানা আরও বলেন, “এরপর ২৬ জানুয়ারি আমি আমার স্বামীর জন্য খাবার ও জামাকাপড় নিয়ে আবার হাতিরঝিল থানায় যাই। ওই সময় ডিউটি অফিসার ফয়সাল ছিলেন।এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। তিনি বললেন, রাজন নামের কেউ নেই। এই ফাঁকে আরেকজন পুলিশ অফিসার এসে বলে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ নামের একজন আছে তো! পরে তাঁকে ডিউটি অফিসার ধমক দেন।’
শামীমা বলতে থাকেন, ‘এরপর ফয়সাল কেমন যেন অভিনয় করছিলেন। তিনি রেজিস্ট্রি বুক খোঁজা শুরু করেন, এটা দেখতে যে রাজন নামে কেউ আছেন কিনা। তখন ফয়সাল পুলিশের উদ্দেশে বলেন, কী বলছেন? থানায় এই নামের কেউ নেই। ঠিক তখনই আমার স্বামী ডিউটি অফিসারের পিছনে অন্য রুম থেকে বলে ওঠে— ফয়সাল স্যার, আমি এখানে আছি। আমি নিজেই এ কথা শুনেছি। আমার হ্যাজবেন্ড আমাকে দেখতে পাননি, কিন্তু আমার কণ্ঠ শুনতে পেয়েছেন।’
শামীমা আরো বলেন, ‘এরপর ফয়সাল আমাকে বললেন, আপনি চলে যান। উনি এখানে নেই। কত স্পষ্ট ডকুমেন্ট, অথচ আমাদের সঙ্গে এগুলো করা হলো। তারপর আমি চলে আসি’
রাজনের স্ত্রী বলেন, ‘এরপরও আমি থানায় যাই। তবে পুলিশ বরাবরই অস্বীকার করেছে। গত রোববার (২৯ জানুয়ারি) একটি মামলায় আমার স্বামীকে গ্রেপ্তার করে আদালতে নিয়ে যায় হাতিরঝিল থানা পুলিশ। এখন কোথা থেকে বের হলেন তিনি? এটা কেমন আইন? গ্রেফতারের পর তাকে আদালতে হাজির না করে সাত দিন আটক রাখা হয়। তার অপরাধ থাকলে আইন অনুযায়ী তার শাস্তি হোক। গতকাল আদালতে স্বামীর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বলছিলেন, তাকে শারীরিকভাবে নি”/র্যাতন করা হয়েছে।
রাজনের ছোট ভাই মহিউদ্দিন খান দেশের একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমরা শুনেছি আমার ভাই থানায় আছে। কিন্তু, পুলিশ বলেছে না। আমার বাবা ৩০ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করছেন। তিনি হ”তাশ। তার পরিবারের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়েছে। যে রাষ্ট্রের জন্য সারাজীবন ব্যয় করলেন, সেই রাষ্ট্রের পুলিশ তাঁর পরিবারের সঙ্গে এমন আচরণ করল। যাই হোক, আমরা একজন লোককে থানা এলাকায় রেখেছিলাম। যার দায়িত্ব ছিল সবকিছুর উপর নজর রাখা। সে টয়লেটের ভেতর থেকে আমার ভাইয়ের ছবিও তুলেছে। তবুও পুলিশ প্রত্যাখ্যান করেছে।
সাত দিন ধরে নিখোঁজ আইনজীবী আবুল হোসেন রাজনকে গত শনিবার রাতে গ্রেপ্তার করে রোববার বিকেলে হাতিরঝিল থানা পুলিশ আদালতে হাজির করে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বি”/স্ফো”রক আইনে দায়ের করা মাম”লায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার দশ দিনের রিমা”ন্ড আবেদন করেন। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি রিমা”ন্ডের শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন আদালত।
গ্রেফতারের পর দীর্ঘদিন ধরে আদালতে হাজির না হওয়ার অভিযোগের বিষয়ে সংবাদ মাধ্যম তেজগাঁও বিভাগের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আজিমুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একটু গ্রামে ছিলাম। এ ব্যাপারে কিছু জানি না।’
এ প্রসঙ্গে হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রশিদ বলেন, রাজনের পরিবারের অভিযোগ, আসলে এ ধরনের কিছুই হয়নি। গত শনিবার রাতে তাকে গ্রেপ্তার করে রোববার সকালে আদালতে পাঠানো হয়। তারা থানার টয়লেটের এডিট করা ছবি দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আসামিকে সাত দিন কা”রাগারে রাখার সুযোগ নেই? তারা নিখোঁজের অভিযোগ করছে। তারা কি কোনো জিডি বা অন্য কিছু নিয়ে অভিযোগ করছেন? রাজনকে সাত দিন ধরে থানায় আটকে রাখা হয়েছে জানতে পারলে থানা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলে আমরা জানতে পারি। তারা যে গল্প বলছে তা বানো”য়াট ও ভিত্তিহীন।
ওসির বক্তব্যে রাজনের স্ত্রী শামীমা সুলতানা ও তার বাবা ইসমাইল হোসেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। তখন শামীমা বলেন, ‘ওসির সঙ্গে কথা বলেছি। এ ছাড়া থানার চিত্রও রয়েছে। অন্য সব কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে। তারপরও পুলিশ যদি এসব বলে, আমরা কার কাছে যাব?’
জিডি সংক্রান্ত এক প্রশ্নে শামীমা বলেন, ‘আমাদের সূত্রে আমরা নিশ্চিত হয়েছি আমার স্বামী পুলিশ হেফাজতে আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি যে, পুলিশ এটা অস্বীকার করে, বিষয়টি নিয়ে এতদূর করবে। তাই জিডি করা হয়নি।
আবুল হোসেন রাজনকে যে অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই মামলার বিষয়ে কথা বলতে চাওয়া হলে, এসআই আসাদ বিন আব্দুল কাদির যিনি মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে রয়েছেন তিনি কথা বলতে আগ্রহী হননি। মোবাইল ফোন বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে তিনি ঠিক কী কারনে রিসিভ করেনননি সেটা জানা যায়নি।