সম্প্রতি বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন ধর্মকে কেন্দ্র নানা ধরনের বিতর্কিত মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।শুধু তাই নয় এ কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।তবে এখন তাকে এসব বিষয়ে তেমন দেখা না গেলেও সামাজিক মাধ্যমে ব্যক্তিগত বিষয়সহ নানা প্রসঙ্গে সরব থাকতে দেখা যায় তাকে।এবার ব্যক্তিগত বিষয়ে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন হুবহু পাঠকদের জন্য নিচে দেওয়া হলো।
বাংলাদেশের প্রথম আলো নিন্দে ছাড়া আমার সম্পর্কে কিছু ছাপায় না। পত্রিকাটির বিখ্যাত লেখক আনিসুল হক ধারাবাহিকভাবে ছাপাচ্ছেন লেখকদের সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। আমার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি একের পর এক কাকে আমি বিয়ে করেছি, তার তালিকা দিলেন। আনিসুল হক কেন এটিকে এত প্রয়োজনীয় মনে করলেন আমি জানিনা। এমন নয় যে তিনি আমার কোনও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন, নিজের চোখে বিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে, এবং এই অভিজ্ঞতার কথা না লিখলে তাঁর আর চলছিল না। তিনি লিখেছেন, কারণ তিনি অন্যের মুখে শুনেছেন বিয়ের কথা। যে তালিকা তিনি দিয়েছেন, সেই তালিকা তো মৌলবাদি এবং নারীবিদ্বেষীর দল প্রতিদিন প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। অজানা কোনও তথ্য নয়। আমার সম্পর্কে যে কিছুই জানে না, আমার লেখা একটি বাক্যও যে কোনওদিন পড়েনি, সে অন্তত বিয়ে ক’টা করেছি তা জানে। জানে ঠিক বলা যাবে না, কারণ ঘটা করে বিয়ে আমি কোনওদিনই করিনি। না আত্মীয় স্বজন, না বন্ধু বান্ধব, না পরিচিত কেউ, না কেউ কোনওদিন দেখেনি আমাকে বিয়ে করতে (বা কারও সঙ্গে সংসার করতে)। তারপরও লোকে আমার বিয়ে নিয়ে মেতে থাকে কেন? কারণ, আমি ক’টা বিয়ে করলাম মানে আমি ক’টা পুরুষের সঙ্গে শুলাম। লোকের উৎসাহ ওই শোয়া ব্যাপারটায়। পুরুষ হাজার মেয়ের সঙ্গে শুলেও একটি মেয়ে সারাজীবন একটি পুরুষের সঙ্গে শোবে, এটিই লোকেরা জানে এবং মানে। এটির অন্যথা হতে দেখলে তারা অবাধে বেশ্যা বলে ডাকবে মেয়েদের, তবেই না তারা পুরুষ! আনিসুল হক নিশ্চয়ই বোঝেন, ওইসব দু’দিনের বিয়ে, যদি সত্যিই ওগুলোকে বিয়ে বলিই (আইনের চোখে সম্ভবত ওগুলো বিয়ে ছিল না, যেহেতু কাবিন বলে কিছু ছিল না ওসবে), আমার জীবনে নিতান্তই অর্থহীন ছিল। কিন্তু অর্থহীন ব্যাপারটিকে একজন লেখকের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বড় অর্থপূর্ণ করে তুলেছেন। তিনি তাঁর লেখার শুরুতেই বিয়ের তালিকা দিয়ে আমাকে লেখক নয়, বরং যাকে দেখি তাকেই বিয়ে করে ফেলি এমন একটি মাথা-খারাপ মেয়ে হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোন পরিস্থিতিতে একটি মেয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়, কোন পরিস্থিতিতেই বা তালাক দিতে বাধ্য হয়, তার উল্লেখ কিন্তু তাঁর লেখাটিতে নেই। আমার বিয়ে নিয়ে তাঁর যদি এতই আগ্রহ, এ নিয়ে লেখার আগে তিনি আমার আত্মজীবনী একবার পড়ে নিলেই পারতেন। নাকি ভুলভাল মন্তব্য বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর কারও বেলায় না করা গেলেও আমার বেলায় করলে কোনও সমস্যা নেই, কারণ গত তিরিশ বছর ধরে তো এ-ই করছে লোকে! দায়িত্বশীল লেখক হিসেবে তাঁর কি উচিত ছিল না সহমর্মী হওয়া? গড্ডালিকা প্রবাহে না ভাসা? নারীবিদ্বেষীদের ভিড়ে মিশে না যাওয়া?
আনিসুল হককে যদি আজ আর্থার মিলার সম্পর্কে লিখতে বলা হয়, তবে তিনি তাঁর বইগুলো পড়বেন, তারপর তাঁর লেখা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা লিখবেন। তিনি কিন্তু একের পর এক আর্থার যে বিয়ে করেছেন, সেসবের দীর্ঘ বর্ণনা করবেন না। কেন করবেন না? আর্থার মিলার পুরুষ, সে কারণে করবেন না। পুরুষ-লেখক কটা বিয়ে করলেন, কজনের সঙ্গে শুলেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি তিনি চিত্রপরিচালক মার্টিন স্করসেসে বা জেমস ক্যামেরন সম্পর্কে লেখেন, তিনি তাঁদের ছবিগুলো দেখে সেসবের ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। স্করসেসে বা ক্যামেরন পাঁচটি করে বিয়ে করেছেন, এটি আনিসুল হকের কাছে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য বিষয় হবে না। একই রকম তিনি যদি সমরেশ বসুকে নিয়ে লেখেন, তাঁর লেখার বিষয় হবে তাঁর লেখা, তাঁর বিয়ে নয়। যদি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখেন, তিনি তাঁর লেখা উপন্যাস বা তাঁর নাটক নিয়ে লিখবেন। যদি তাঁর বিয়ের ব্যাপারটি কোনও কারণে উল্লেখ করেনই, তাঁকে মোটেও হেয় করার জন্য, বা তাঁকে নিয়ে তামাশা করার জন্য উল্লেখ করবেন না। বরং হুমায়ূন আহমেদ মানুষ হিসেবে কত মহান, কত গুণী, তা বলবেন। ক’দিন হুমায়ুন আহমেদ কাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছেন, কাকে আবার হুট করে বিয়ে করে ফেলেছেন, এগুলো প্রধান বিষয় হবে না তাঁর লেখার। আমাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে সবচেয়ে মূখ্য করেছেন আমার বিয়ে, সবচেয়ে গৌণ করেছেন আমার লেখালেখি। তাঁর প্রথম লাইনটি এই,’ তসলিমা নাসরিন সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন কলামে টাকার বিনিময়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন।’ টাকার বিনিময়ে যে বিখ্যাত কবি রফিক আজাদও ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপন প্রকাশ করতেন, তা কিন্তু তিনি উল্লেখ করেননি, এবং রফিক আজাদ সম্পর্কে লিখলে তিনি কিন্তু ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের কথা একেবারেই উল্লেখ করবেন না। কারণ ”টাকার বিনিময়ে লেখা ছাপানো” মোটেও গৌরবের কথা নয়। প্রথম লাইনটিতেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি আমাকে নিয়ে কাউকে গৌরব করতে দিতে রাজি নন। এরপরই বলেছেন আমার মেডিক্যাল কলেজে পড়ার কথা। মেডিক্যালে পড়ার আগে এবং পড়াকালীন আমি যে বিভিন্ন লিটল ম্যাগে কবিতা লিখতাম দীর্ঘ বছর, আমি যে সতেরো বছর বয়স থেকে কবিতা পত্রিকা ‘সেঁজুতি’ সম্পাদনা করতাম, সেই পত্রিকা যে টাকার বিনিময়ে লোকে কিনতো, সেটির কোনও উল্লেখ নেই তাঁর লেখায়। আমার সম্পর্কে লেখার আগে আমার লেখা ৪৫টি বইয়ের একটিও পড়ে দেখারও প্রয়োজন তিনি মনে করেননি। আমি যে মানুষ হিসেবে উদার, বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, আমার সেন্স অব হিউমার ভালো, আমার লেখার ক্ষমতা ভালো, আমি সৎ এবং সাহসী, আমি বিপ্লবী, সংগ্রামী, আপোসহীন, এসব তাঁর চোখে পড়েনি। চোখে পড়েনি সমাজের মেয়েরা যে আমার লেখা পড়ে জেগে উঠেছে, সচেতন হয়েছে, সেসবের কিছুই। পুরুষ-লেখক হলে এসব চোখে পড়ে। কারণ পুরুষ-লেখকরা তো লেখক, যৌনাঙ্গ নয়।
২০২২