আগা খান ( Aga Khan ) আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড বড় ধরনের সম্মানজনক পুরস্কার এবং এই পুরস্কার দেয়া হয় অনবদ্য এবং কৃতিত্বপূর্ণ পরিবেশবান্ধব স্থাপত্যের নকশা অনুযায়ী নির্মানের কারণে। এবার এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য মনোনীত হয়েছে বাংলাদেশের ( Bangladesh ) দুটি প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলো নির্মাণ করে বাংলাদেশের ( Bangladesh ) প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট থেকে বেরিয়ে আসা কয়েকজন তরুণ স্থাপত্য প্রকৌশলী। বাংলাদেশ এর আগেও ২ বার এই পুরস্কার পান কয়েকজন তরুণ।
পাখির চোখে টেকনাফের রো’হি”ঙ্গা আশ্রয়শিবিরের কমিউনিটি স্পেস
তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া প্রকল্প গুলো হলো টেকনাফ, রো”/হিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে নির্মিত কমিউনিটি স্পেস ও ঝিনাইদহের আরবান রিভার স্পেস।
গত বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৪৬৩টি প্রকল্প থেকে নির্বাচকরা এই ২০টি প্রকল্প নির্বাচন করেছেন।
সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত প্রকল্পগুলি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের চূড়ান্ত পুরস্কারের জন্য প্রতিযোগিতা করবে। গত বৃহস্পতিবার লন্ডনের কিংস ক্রসে একটি প্রদর্শনীতে সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত এই স্থাপত্যগুলোর ছবি প্রদর্শন করা হয়েছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত প্রদর্শনী চলবে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
রো’/হিঙ্গা ক্যাম্পে কমিউনিটি স্পেসের স্থপতিরা হলেন রিজভী হাসান, খাজা ফাতমি এবং সাদ বিন মোস্তফা। তিনজনই ২০১৭ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক হন। তিনজনের মধ্যে স্থপতি রিজভী হাসান ২০২০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প।
স্থপতি খাজা ফাতমি রো’/হিঙ্গা ক্যাম্পের ওই কমিউনিটি স্পেসের নকশা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তারা রো’/হিঙ্গা কারিগরদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করেছেন এবং গতানুগতিক পদ্ধতিতে কোনো নকশা বা মডেল তৈরি না করেই নির্দেশনা দিয়েছেন। খাজা ফাতমি বলেন, ‘গত্বাঁধা কোনো ভবন নয়, বরং এমনভাবে কাজটা করতে চেয়েছি যাতে পুরো জনগোষ্ঠীর উপকার হয়। বাঁশ, শন, গোলপাতা, বেতের মতো স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা পরিবেশবান্ধব কাঁচামাল ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছে টেকসই এই স্থাপনা।’ তিনি বলেন, ব্র্যাক, এইচসিএমপি এবং অ্যাকশনএইডের সহায়তায় তারা ২০১৬ সাল থেকে ঐ ক্যাম্পে মোট ছয়টি স্থাপনা নির্মাণ করেছে। লক্ষ্য ছিল নারী ও ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ স্থাপনা তৈরি করা, যাতে মাটির কোনো ক্ষতি না হয়। তারা যদি কোনোদিন এখান থেকে চলে যায় তারপরও ব্যবহার করা হবে।
বাঁ থেকে খাজা ফাতমী, রিজভী হাসান ও সাদ বিন মোস্তফা।
স্থপতি সাদ বিন মোস্তফা বলেন, “প্রতিটি স্থাপনার আয়তন ১২০০ থেকে ৫০০০ বর্গফুট। প্রতি বর্গফুটে মাত্র ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা খরচ হয়েছে। নারীবান্ধব প্রকল্পটি সেখানকার নারীদের জন্য স্থাপত্যের সামনে একটি উঠান তৈরি করেছে। তাদের জন্য কাউন্সেলিং সহ বিভিন্ন দক্ষতা বিকাশের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। সাদ বিন মুস্তাফা বলেন, ‘শাহ আলম, তাহরিমা আক্তার, হাসান তারেক, বিপ্লব হোসেন, শেখ জাহিদুর রহমান, মোঃ আব্দুল আলিম, আবিদ ইবনে রহমান এবং আরও অনেকে বিভিন্ন উপায়ে এই প্রকল্পে সহায়তা করেছেন।’
এদিকে, ঝিনাইদহের আরবান রিভার স্পেস অন্তর্ভুক্তিমূলক নগরায়নের পাশাপাশি পরিবেশগত সংবেদনশীলতার এক অনন্য উদাহরণ। এর স্থপতি খন্দকার হাসিবুল কবির ও সুহেলী ফারজানা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসিবুল কবির কো-ক্রিয়েশন আর্কিটেক্টের প্রধান। ঝিনাইদহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নবগঙ্গা নদী। সেই নদীর তীরে তারা গড়ে তুলেছে হাঁটার পথ, আড্ডাঘর ও সাংস্কৃতিক স্থান। এতে এলাকার পুরো চিত্রই পাল্টে গেছে।
হাসিবুল কবির বলেন, ‘আমরা ২০১৫ সালে কাজ শুরু করি। আমরা নদীকে কেন্দ্র করে শহরকে সাজাতে চেয়েছিলাম। নগরীর মেয়র থেকে শুরু করে হকারদের সবাইকে এ কাজে সম্পৃক্ত করেছি। স্থপতি সুহেলী ফারজানা বলেন, মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে স্থাপনা নির্মাণই আমাদের কাজের প্রধান উপজীব্য। নানাভাবে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে ‘সিটি ওয়াইড পিপলস নেটওয়ার্ক’ও গড়েছি। আমাদের স্লোগান ‘নদী ও পুকুরের দিকে করি মুখ/বাড়িয়ে দেই ঝিনেদার সুখ’। ”
খন্দকার হাসিবুল কবির ও সুহাইলী ফারজানা।
আগা খান পুরস্কার স্থাপত্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার। ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতি তিন বছর পর পর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এতে সমসাময়িক নকশা, সামাজিক আবাসন, সামাজিক অগ্রগতি, উন্নয়নসহ অনেক দিক বিবেচনা করা হয়। আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া অন্যান্য স্থাপত্য পুরস্কার নির্বাচন পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। শুধু স্থাপত্যের নান্দনিক দিকই নয়, সার্বিকভাবে জীবনের গুণগত মানোন্নয়নের দিকেও খেয়াল রাখা হয়। স্থাপনা বা ব্যক্তির পাশাপাশি এটি প্রকল্প, সম্প্রদায় ও এর অংশীদারদেরও স্বীকৃতি দেয়। পরিকল্পনা এবং ঐতিহাসিক সংরক্ষণের উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি, উদ্ভাবনী ধারণাগুলিও দেখায় যে স্থাপত্যটি কতটা পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ। আগা খান ফাউন্ডেশন স্থাপত্য চর্চার মাধ্যমে মানবজাতির চাহিদা ও আকাঙ্খা পূরণে প্রায় চার দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ১২১টি প্রকল্পকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে এবং প্রায় ১০,০০০টি ভবনের প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে।
বাংলাদেশীদের মধ্যে, ২০১৯ সালে স্থপতি সাইফ-উল-হকের ডিজাইন করা কেরানীগঞ্জের আর্কেডিয়া শিক্ষা প্রকল্পটি আগা খান পুরস্কার জিতেছে। স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম এবং কাশেফ মাহবুব চৌধুরী ২০১৬ সালে পুরস্কার জিতেছিলেন।
উল্লেখ্য, আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার ১৯৭৭ সাল থেকে প্রবর্তিত একটি স্থাপত্য বিষয়ক সম্মাননা পুরস্কার। এই পুরস্কারের প্রধানতম লক্ষ্য হলো স্থাপত্য নকশা, সামাজিক অবস্থান, সম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন ধরনের ইসলামিক সমাজের প্রয়োজনে নির্মিত স্থাপত্যের বিষয়টি প্রসার করা। এই পুরস্কার দেয়া হয় প্রতি তিন বছর অন্তর। এই পুরস্কারের অর্থমূল্য ৫ লক্ষ মার্কিন ডলার। তবে আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশ এই পুরষ্কারের তালিকায় উঁচুতেই থাকবে।