Friday , September 20 2024
Breaking News
Home / Countrywide / পদ্মা সেতু: নির্মাণের সময় খরস্রোতা পদ্মাকে যেভাবে বাগে আনা হয়েছিলো

পদ্মা সেতু: নির্মাণের সময় খরস্রোতা পদ্মাকে যেভাবে বাগে আনা হয়েছিলো

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের তারিখ নির্ধারন করা হয়েছে ২৫শে জুন। পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা এমনটাই জানিয়েছেন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার গণভবনের সামনে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। সরকার ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু পারাপারের টোলের হার নির্ধারণ করেছে। ১৭ মে, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রক বিভিন্ন ধরণের পরিবহনের জন্য বিভিন্ন টোল হার নির্ধারণ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পদ্মা সেতু পার হতে বড় বাসে দুই হাজার ৪০০ টাকা এবং মাঝারি ট্রাকে দুই হাজার ৬০০ টাকা লাগবে এমনটাই প্রজ্ঞাপনে নির্ধারন করা রয়েছে।

পদ্মা সেতুর প্রস্তাবিত টোল হার অনুমোদনের জন্য গত ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রস্তাব পাঠায় সেতু মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদনের পর তা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সেতু বিভাগের প্রস্তাবিত টোল হার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অনুমোদন দিয়েছে।পদ্মা নদী পৃথিবীর বৃহত্তম নদীগুলোর একটি। এ নদীতে প্রবাহিত পানির পরিমাণ, নদীর গভীরতা ও প্রস্থ এবং তলদেশের মাটির প্রকারের কারণে এর ওপর সেতু নির্মাণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত এই অসম্ভব কাজটি সম্ভব হবে এবং প্রায় আট বছর নির্মাণের পর আগামী ২৫ জুন সেতুটি উদ্বোধন করা হবে। এই পদ্মা সেতু নির্মাণে ধাপে ধাপে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে এবং সেগুলো সামাল দিতে সেতুর নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। নয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল পদ্মা নদীর তলদেশে মাটির গভীরে স্তূপ স্থাপন করা। পৃথিবীর আর কোনো নদী এত গভীরে নির্মিত হয়নি যেখানে কোনো পাইলিং করা হয়নি।

পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলীরা বলছেন, যমুনা সেতু ও গঙ্গা নদীর ওপর হার্ডিঞ্জ সেতু নির্মাণ থেকে অর্জিত জ্ঞান সেতু নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে জনগণের মাথায় গুজব কেন? পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে প্রচুর কৃষি ও পরিবহন কার্যক্রম চলে। নদীর তলদেশের মাটির ধরন পদ্মা নদী একটি পলি নদী, অর্থাৎ এই নদীটি পাললিক পাথরের মধ্য দিয়ে সাপের মতো প্রবাহিত হয়। বৈচিত্র্যময় চরিত্রের কারণে এটি একটি লোভনীয় নদীও বটে। এর কিনারাগুলোও খুব ভেঙে গেছে। প্রকৌশলীরা বলছেন, এত বড় এবং মাথাচাড়া দিয়ে উঠা নদীর উপর এত বড় সেতু তৈরি করা ছিল একটি বড় প্রকৌশল চ্যালেঞ্জ। পদ্মা সেতু নির্মাণে কর্মরত বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য নদী ব্যবস্থাপনার কাজ তদারককারী আইনুন ড. নিশাত বলেন, পদ্মার তলদেশে ও দুই পাশে নরম মাটি ও বালি। যে কারণে কাজটি ছিল খুবই কঠিন ও জটিল। নরম হওয়ার কারণে নদীর তলটি আরও তলিয়ে যেতে পারে বা উভয় পাশে ভেঙে যেতে পারে। শীতকালে পদ্মা নদীর গভীরতা প্রায় ১০০ ফুট। বর্ষাকালে এই গভীরতা দ্বিগুণ হয়। সে কারণেই চ্যালেঞ্জ ছিল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা যাতে সেতুর স্তূপগুলো নদীর ওই গভীরতায় স্থাপন করা যায়।

বাংলাদেশে নদীতে পাথর নেই। ফলে সেতুর পুরো ওজন মাটিতে রাখতে হবে। এ কারণে নদীতে অনেক ভারী পাথর, কংক্রিটের ব্যাগ ও জিওব্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যবহৃত প্রতিটি পাথরের ওজন ৮০০ কেজি থেকে এক টন পর্যন্ত। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মাতাল নদীতে স্তূপ স্থাপন করা। এই পাথরগুলো ইন্টারলক করার জন্য মিশ্রিত করা হয়। সেগুলো নদীর তলদেশে নামানো হয়েছে। ড্রেজ যত গভীর হবে, ততই গভীর হবে, ডঃ আইনুন নিশাত বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম তিনটি ড্রেজার আনা হয়েছিল। নদীর তলদেশে একটি ৮০০ কেজি জিওব্যাগে নীচের স্তরটি তুলনামূলকভাবে মোটা বালি দিয়ে ভরা ছিল। নিশাত তিনি বলেন, যখন পদ্মা সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল, তখন মাটির গুণমানের রিপোর্টে দেখা গেছে যে মেঝেতে সমজাতীয় মাটি বা একই ধরনের মাটি ছিল। কঠিন কাজ।

২২৫ থেকে ২৩০ মিটার ভূগর্ভে যেতে হবে। ১০ ফুট ব্যাসের একটি স্টিলের পাইপ একটি হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে মাটিতে স্থাপন করতে হবে। এ জন্য প্রথমে ১ হাজার টন, তারপর দেড় হাজার টন, ২ হাজার টন, ২ হাজার ২শ’ টন এবং পরে আড়াই হাজার টন তাই হাতুড়ির ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। ২৫০০ টন ওজনের একটি হাতুড়ি বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার সময় হাতুড়িটি ফেটে গেছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, সেতুর ভার বহনের জন্য যে গভীর স্তূপ প্রয়োজন তা একটি অসম্ভব চ্যালেঞ্জ। এটিকে এত গভীরে যেতে হবে কারণ প্রথম ৬০ থেকে ৭০ মিটার কেবল পানি, যেখানে স্তুপে কোনও শক্তি নেই। ফেরির তুলনায় পদ্মা সেতুতে টোল দেড় গুণ, ফেরি ফিও বাড়ছে। অনেক অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও শেষ পর্যন্ত সেই গভীরতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এরপর সেতুর নকশা পরিবর্তন করা হয়। পদ্মা নদী খুবই শক্তিশালী ও বিশাল। পদ্মা পৃথিবীর বৃহত্তম নদীগুলোর একটি। পৃথিবীর একমাত্র নদী যেখানে এর চেয়ে বেশি জলপ্রবাহ রয়েছে তা হল আমাজন এবং সেই নদীর উপর কোন সেতু নেই।

পদ্মা সেতুর খরচ কি সত্যিই অনেক বেশি? উল্লেখ্য যে বিশ্বের শীর্ষ ১০ থেকে ১৫টি প্রধান নদীর মধ্যে দুটি হল গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র। কিন্তু পদ্মা নদী এই দুই নদীর সমষ্টি। আইনুন নিশাত জানান, সিরাজগঞ্জের ব্রহ্মপুত্রের উজানে ১২ থেকে ১৪ কিলোমিটার প্রশস্ততা রয়েছে। রাজশাহীতে পদ্মার প্রস্থ চার থেকে ছয় কিলোমিটার। ফলে পদ্মা সেতু নির্মিত মাওয়ায় প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে যে পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়, সেটি ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত পদ্মা নদী দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার চেষ্টা করে। বর্ষাকালে এই পানির স্রোত প্রতি সেকেন্ডে প্রায় পাঁচ মিটার। অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে এই নদী দিয়ে ১.৫ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। শীতকালে স্রোত কমে গেলে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় দেড় মিটার। ড.নিশাত বলেন, পদ্মা সেতুতে পানি প্রবাহ দুই মিটারের কম হলে সেতুটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ঠিকাদারকে বলা হয়েছে তিনি বর্ষায় কাজ করতে পারবেন না। কারণ সেখানে কোনো বার্জ রাখা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, স্টিলের তার দিয়ে বার্জটি মুরিং করার পরও স্রোতে বার্জটি ভেসে গেছে।

প্রকৌশলীরা বলছেন, বর্ষায় নির্মাণ কাজের সময় পদ্মা নদীতে বার্জ, ড্রেজার ও ক্রেন কাঁপতে দেখা গেছে। তারা বলছেন, সেতুটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে এর শক্তিশালী পিলারগুলো নদীর প্রবল স্রোত সহ্য করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে নদীর পরিবেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। তাই নদীর স্বাভাবিক গতিপথে কোনো বাধা ছিল না। নদী কোথাও সংকুচিত হয়নি। পদ্মা নদী ও এর আশপাশে সেতুর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। ইলিশ মাছের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। আইনুন নিশাত জানান, নদীর গভীরতা ২০ ফুটের বেশি হলেও ইলিশ মাছ যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে সেজন্য ওই গভীরতায় কাজ বন্ধ রয়েছে। স্ট্যাকিংয়ের সময় যে শব্দ হয়েছিল, স্তুপ থেকে ১০০ ফুট, এক কিলোমিটার এবং পাঁচ কিলোমিটার দূরে, তা দিনে দু-তিনবার পরিমাপ করা হয়েছে যাতে ইলিশ মাছ পছন্দ না করে।

এছাড়াও নদীর পশ্চিম পাশে চর জানাজাতের কাছে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার লম্বা ও এক থেকে তিন কিলোমিটার চওড়া চরে অনেক কচ্ছপ ডিম পাড়তে আসে। এসব কচ্ছপ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেতুর দক্ষিণে একটি বড় চরকেও সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। যেখানে মাছ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বনায়নের বিশাল এলাকা রয়েছে, তাই লাখ লাখ দেশীয় প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত সহজ হবে এবং সময়ও কমবে। চলাচলের সুবিধার পাশাপাশি পদ্মা সেতু দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। জরিপে বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে মোট দেশের উৎপাদন (জিডিপি) ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি ২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লীষ্টরা।

 

 

About Syful Islam

Check Also

আ.লীগ ও তৃণমূল থেকে বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিএনপিতে যোগদানের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *