সৌরভের বয়স ১৬ বছর, আর এই বয়সের শেষ ৮ বছর কাটিয়ে দিয়েছে ময়মনসিংহ রেল স্টেশন প্ল্যাটফর্মে। এখন তার সাথে আছে স্টেশনে বসবাস করা আরো ১২ জন শি’/শু। প্রায় বছর ৩ আগে একটি এনজিও’র নজরে আসে সৌরভ, তার আচারন দেখে আকর্ষিত হয় ঐ এনজিও। সৌরভ বর্তমান সময়ে পথশি’/শুদের নিয়ে কাজ করছে এমন ধরনের একটি এনজিও থেকে প্রতি মাসে কিছু পরিমান টাকা পায়। সে সেই টাকা থেকে কিছু টাকা তার এক পরিচিত দিদির নিকট সঞ্চয় করে। সে তার প্রতিবন্ধী বোনকে কিছু পরিমান টাকা দেয়, যে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। এবং কিছু টাকা দিয়ে সে মাঝে মাঝে রেল স্টেশনে অন্যান্য যে সকল পথশি’/শু রয়েছে তাদের জন্য কলা বিস্কুট সহ সামর্থ্যের মধ্যে থাকা বিভিন্ন ধরনের খাবার কিনে দেয়। তার আচরণ, মানবিকতা এবং বন্ধুত্ব দিয়ে সৌরভ রেল স্টেশনের ছোট্ট ছেলেমেয়েদের বড় ভাই হয়ে উঠেছে। বি’প/দের বন্ধুতে পরিনত হয়েছে এই পথশি’/শু সৌরভ।
এনজিও’র কাজের বাইরেও সৌরভ স্টেশনে পানি বিক্রি করে। এখনও তার ঠিকানা রেল স্টেশনের প্লাটফরম। তবে সৌরভের স্বপ্ন কোনো এক দিন টাকা-পয়সা জমে গেলে সে দোকান দেবে। মানুষের বাড়িতে রাখা তার বোনকে নিয়ে একটা ছোট্ট ঠিকানা খুঁজে নেবে।
সৌরভ এবং কারিতাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলাপে জানা যায়, ছোট বেলাতেই মা-বাবার স্নেহ ও সান্নিধ্য থেকে বঞ্চি’ত হয় সৌরভ। বাবা ২য় বিয়ে করে চলে যান। আর মানসিক আ’/ঘা’/তে মা হন নিরুদ্দেশ। এরপর তার আশ্রয় মেলে নানীর কাছে। ময়মনসিংহ শহরের ব্রাহ্মপলস্নী এলাকায় থাকাকালে সেই নানীও মা’/রা যান। তখন সৌরভের বয়স ৮ বছর। আর তার বোনের বয়স ছিল ১০। তখন থেকেই সৌরভের ঠিকানা হয় রেল স্টেশনে। আর বোনকে গৃহকর্মী হিসেবে অনুরোধ করে এক বাসায় রেখে আসে সৌরভ।
পথশি’/শু হিসেবে সৌরভের জীবন শুরু হয় সারাদিন ভিক্ষাবৃত্তি আর ঘুরাঘুরি করে। অনেক সময় কপালে জুটতো মানুষের মা’/রধ’/র কিংবা ব’কাঝ/কা। আর দিন শেষে রেলস্টেশনের প্লাটফরমে ঘুমানো। এক সময় সে পানি বিক্রির কাজ শুরু করে। কিন্তু শরীর নোংরা থাকায় কেউ তার কাছ থেকে পানিও কিনতে চাইতো না।
কারিতাস ড্রিম প্রকল্প ময়মনসিংহ এলাকায় ২০১৮ সাল থেকে পথশি’/শুদের জীবনমান উন্নয়ন, তাদের অধিকার ও সুরক্ষায় কাজ শুরু করে। কাজের অংশ হিসেবে রেল স্টেশনে যান কর্মকর্তারা। পথশি’/শুদের শনাক্ত করে তাদের জীবনমান উন্নয়নে চলে বেশ কিছু কাজ। সেখানে যুক্ত হয় সৌরভ। কারিতাস কর্মকর্তারা দেখেন মা-বাবা হারা শি’/শুদের প্রতি সৌরভ অন্যরকম ভালোবাসা দেখায়। সে অন্য শি’/শুদের নিজের ভাইয়ের মতো করে আদর স্নেহ করে। শি’/শুদের প্রতি তার এই ভালোবাসার কারণেই ২০১৯ সালের শুরুর দিকে কারিতাস ড্রিম প্রকল্পে সৌরভকে পিয়ার এডুকেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং মাসে ৬ হাজার টাকা বেতনও দেয়া হয়।
কারিতাস ড্রিম প্রকল্পটি গত বছর শেষ হয়ে বর্তমান বছরে আলোকিত শি’/শু প্রকল্প নাম নিয়ে কাজ করছে। সৌরভ এ প্রকল্পেও যুক্ত আছে। এ প্রকল্পের মাঠ কর্মকর্তা বিপাশা মানকিন বলেন সৌরভ কিছু টাকা সঞ্চয় করে। কিছু টাকা তার বোনকে দেয়। আর কিছু টাকা দিয়ে সে স্টেশনের অন্য শি’/শুদের মাঝে মাঝে খাবার কিনে দেয়। কোনো শি’/শু অসুস্থ হলে সৌরভই হাসপাতালে নিয়ে যায়। শি’/শুদের খোঁজ-খবর রাখে, কোনো শি’/শু সমস্যায় পড়লে সবার আগে সে এগিয়ে আসে। বিপাশা মানকিন বলেন সৌরভের আচার-আচরণ ও মানবিকতা অন্যদের চেয়ে বেশ আলাদা। সৌরভের সঙ্গে স্টেশনে রাত কা’টায় ৭ বছরের আব্দুল্লাহ।
আবদুল্লাহ জানিয়েছে, সৌরভ ভাই আমাদেরকে খাবার দেয় এবং কোনো ধরনের অ’ন্যায় করতে দেখলে শা’স/নও করে। ২ বছর ধরে সৌরভের সাথে থাকে আরেক পথশি’শু নাম তার রনি। রনি আগে থাকতো ঢাকার একটি রেল স্টেশনে, সেখানে প্লাটফর্মেই কটতো তার দিন রাত। সৌরভকে দেখিয়ে, রনি বলে, সৌরভ ভাই সবসময় আমাকে দেখেশুনে রাখে এবং সে আমার বি’প/দে-আপ’দে এগিয়ে আসে।
সৌরভ জানান, তার আলাদা কোনো জায়গা নেই রাতে থাকার জন্য তাই স্টেশনেই সে রাত কাটাই। সে যখন সময় পায় তখন পানি বিক্রি করে কিছু আয় করে। এবং তার সাথে থাকে আরো ১২ জন শি’/শু যারা রাতে স্টেশনের বিভিন্ন স্থানে একসাথে ঘুমায়। ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে সৌরভ বলে, যদি কোনো দিন কিছু টাকা জমাতে পারি তাহলে একটি দোকান দিব। আমার যে বোন আছে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসবো। সে স্টেশনে যে সকল পথশি’/শুরা থাকে তাদের দেখাশোনাও করবে।