সৈয়দপুরে একই পরিবারের দশ সদস্যকে হারিয়ে এখনো নীরবে কেঁদেছেন নগরীর ৬০ বছরের বৃদ্ধ আ. রশিদ যুগ যুগ ধরে হত্যাকাণ্ডের স্বীকৃতি ও বিচারের দাবিতে বিভিন্ন দফতরে গিয়েও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
শুক্রবার (১ ডিসেম্বর) সকালে নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাশবাড়ি এলাকার ওই বাড়িতে গিয়ে কথা হয় আ: রশিদের (৬৪) সঙ্গে। ভয়াল সেদিনের ভয়াবহতার কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
তিনি জনসম্মুখে বলেন, দাদা আ. ওয়াদুদ ও বাবা। শহিদ একটি রুটি বিস্কুটের কারখানা চালাতেন। তাদের খাদ্যপণ্য স্থানীয় বিহারীদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। এই ব্যবসা দ্রুত প্রসারিত হয়. তারা একটি ভাল দিন ছিল.
তবে এই শহরে পাকিস্তানপন্থী অবাঙালিদের জীবনযাপন করতে হয়েছে দুর্বিসহ। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় শহরটি মিনি পাকিস্তানে পরিণত হয়। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হন। এ সময় পাউরুটি, বিস্কুটসহ অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর প্যাকেটে নৌকা প্রতীককে ট্রেডমার্ক হিসেবে বাজারজাত করা হতো।
এভাবে বাঙালীর অহেতুক নেতার পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের প্রায় সবকটি আসনেই জয়ী হন।
তবে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে। এ শহরের উপকণ্ঠে পাকিস্তানিরা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তারা আরও শক্ত রূপ নেয়। এটা কেউ বুঝল না।
কিন্তু নৌকার ছাপ বাঙালির মনোবল দৃঢ় করে। এটা বুঝতে পেরে বিহারী নেতারা ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল রাতে বাড়িতে সবচেয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায়। দাদী শাহিদা খাতুন তার জীবন বাঁচাতে এক ধর্মদ্রোহীর পা জড়িয়ে ধরেন। কিন্তু সে বৃদ্ধ দাদীর গালে চড় মেরেছে। ব্যানেট চার্জে তিন রাজাকাকে হত্যা করা হয়। তারপর একই ভাবে দাদার কাছে। বাড়ির লোকজনের কান্নায় আকাশ ভরে ওঠে।
তারা দাদা-দাদীকে গোসল না করে কফিন দিয়ে মাটিতে পুঁতে দেয়। কয়েকদিন পর মৃতদেহ সরিয়ে দহলায় দাফন করা হয়। ঘটনার সময় আবু সাকের বাবা ও বড় ভাই সেখানে ছিলেন না। তারা পাকিস্তানিদের নির্দেশে সৈয়দপুর বিমানবন্দর নির্মাণের কাজ করছিল।
পরে তাদের ভয়ে পাশের এক অবাঙালির বাড়িতে আত্মগোপন করে। পাকসেনা ও বিহারিরা জানতে পেরে সদ্য বিবাহিতা বড় বোন নুরজাহানকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। তারপর তারা তার দুই স্তন কেটে ফেলে তাকে জবাই করে। মা আসমা বেগমের সাথে বাবা মোঃ শহীদ, বোন সাকিনা বেগম, ফিরোজা বেগম, হাসিনা বেগম, ভাই আবু সাকের, মোঃ রাশেদকেও হত্যা করে। তারা আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করলেও তাওহিদ নামের একজনের দয়ায় আমি রক্ষা পেয়েছি।
স্বাধীনতার পর এতিমরা জীবনে শ্যাওলার মতো বেড়ে উঠেছে। তবে বড় হয়ে শহীদদের স্বীকৃতি ও বিচারের জন্য বহুবার প্রতিবাদ করেছি। কোন লাভ হয়নি। আমি এখনও আশাবাদী. বঙ্গবন্ধু কন্যা একদিন ত্রিশ লাখ শহীদের মূল্য দিতে পারে। জীবনের শেষ প্রান্তে এমন প্রত্যাশা নিয়েই বেঁচে আছি। হয়তো পিশাচদের সুষ্ঠু বিচার হবে।
শহীদ পরিবারের সন্তান ও সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহসিনুল হক বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত চলছে। এই শহরে না। এখানে প্রায় ৫ হাজার বাঙালিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
প্রজন্ম-৭১-এর সভাপতি ও শহীদ পরিবারের সন্তান মনজুর আলম বলেন, জীবনের শেষ প্রান্তে আশার আত্মত্যাগের মূল্যায়ন ও হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সাপেক্ষে। তবেই ত্রিশ লাখ শহীদ ও তাদের পরিবারের আত্মা শান্তি পাবে।