আওয়ামী লীগ বর্তমানে নেতৃত্ব সংকট ও ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে, যা দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজনের আশঙ্কা বাড়িয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে দল পুনর্গঠন কঠিন হয়ে উঠবে এবং এমনকি বিভক্ত হয়ে নতুন দল গঠনের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে (২৭ জানুয়ারি) এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিশ্লেষক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান প্রতিবেদনে বলেন, আওয়ামী লীগ বর্তমানে গভীর সংকটে রয়েছে। দলটির ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নেতৃত্বের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বিভাজন দেখা দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা অতীতে নির্বাসনে ছিলেন এবং ফিরে এসে দলকে পুনর্গঠিত করেছিলেন। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। সেনাসমর্থিত ছাত্র অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ফলে তার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ চারটি প্রধান শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন, যা পূরণ না হলে দলটির প্রত্যাবর্তন কঠিন হবে।
১. ১৬ বছরের শাসনামলে সংঘটিত অপরাধের জন্য দায় স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া।
2. দলের বর্তমান আদর্শ ত্যাগ করা।
3. শেখ হাসিনার পরিবারের কোনো সদস্য ভবিষ্যতে দলের নেতৃত্বে থাকবে না, তা নিশ্চিত করা।
4. মানবতাবিরোধী অপরাধ ও ২০২৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতায় অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করা।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় সংঘটিত সহিংসতার জন্য তাকে এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নেতাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। এটি ছাড়া আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান সম্ভব নয়।’
ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলনের পর বিএনপি ও জামায়াত আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচারের দাবিতে সরব হয়েছে। তারা বলছে, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে দেশের জনগণ।
২৫ জানুয়ারির এক পথসভায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘২০২৬ সালের প্রথম দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। আমাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক সংস্কার নয়, বরং খুন, গুম ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।’
অভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগের করুণ পরিণতি
আল-জাজিরার “আফটার দ্য ব্লাডশেড: ক্যান বাংলাদেশ’জ আওয়ামী লীগ রিসারেক্ট ইটসেল্ফ?” শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হন রংপুরের আবু সাঈদ। এ সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা পরিস্থিতি নিয়ে উদাসীন ছিলেন। এমনকি ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন না করে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন।
এরপর ১ জুলাই শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন ৫ আগস্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৮৩৪ জন নিহত হন এবং ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হন। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান।
বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে রয়েছেন। দলে নেতৃত্বের অভাব দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে দলের শীর্ষ নেতারা দল পুনর্গঠনের আহ্বান জানাচ্ছেন, তবে বাস্তব পরিস্থিতি তাদের পক্ষে নেই।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম আল-জাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার।’ তবে তিনি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা গোষ্ঠীকে দায়ী করেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ব্যর্থতা এবং জনগণের আস্থাহীনতা দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী দিনে দলটি টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন এবং জনগণের সমর্থন আদায়ের উপর।