আমাকে প্রায়ই নুহাশপল্লী যেতে বলা হয়, কিন্তু আমার নুহাশপল্লী যাওয়ার কোন ধরনের ইচ্ছা করে না আমার, হয়তো কখনও নুহাশপল্লীতে আমি যাব না-এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে যোগদানের পর তিনি তার বক্তব্য দেওয়ার শেষ সময়ে এই ধরনের কথা বললেন। এক সময় তিনি দেশের বিনোদন জগতে বাকের ভাই হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন।
তার কথা শোনার পর কৌতূহল ও বিস্ময় সৃষ্টি হয় যথারীতি যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে। যার জন্য আসাদুজ্জামান নূর আজকের বাকের ভাই হিসেবে পরিচিত, আসাদুজ্জামান নূর কেন হুমায়ূন আহমেদের সমাধিতে যেতে চাইছেন না?
হুমায়ূন আহমেদের জীবনে তার অবদানের কথা এক বাক্যে স্বীকার করে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয়, আমাকে জনপ্রিয় অভিনেতা বানিয়েছেন। তার সাথে আমার অজস্র স্মৃতি রয়েছে। তাকে নিয়ে আমার যে স্মৃতি সেটা বলে শেষ করা যাবে না। সেখানে অনেক মজার গল্প আছে। এরকম মজার গল্প অনেক জায়গায় বলেছি। ‘
নূর বলেন, ‘আগুনের পরশমনি চলচ্চিত্রের সময়ের ঘটনা। পাক হা’/না’দার বা’/হি’/নীরা এদেশের মানুষকে কু’কুরের সঙ্গে বিবেচনা করতো। তারা মানুষকে তো মেরেছেই কু’কুরকে মা’/রতেও দ্বিধাবোধ করতো না। মানুষ ম’/রে পড়ে আছে, একদিকে ম’/রে পড়ে আছে কুকুর। আমাদের ছবিতে এমন একটি দৃশ্যের জন্য মৃ’/’ত কুকুর দরকার। আমরা কি করবো? আমাদেরকে কুকুর মে’/রে শুটিং করতে হবে, আমরা মৃ’/ত কুকুরের জন্য করপোরেশনের কাছে যাই। এখন অবশ্য প্রাণী মা’/রা নিষেধ। তখন অন্যরকম পরিস্থিতি ছিল। এখন কোনোভাবেই কু’কুরকে মা’/রা যাবে না। বিদেশের সিনেমা ম’/রা প্রাণী দেখানোর জন্য সেভাবে তৈরি করা হয়।
দেশের জনপ্রিয় এই অভিনেতা বলেন, ‘তো আমরা করপোরেশনে গেলাম। আমাদের জিজ্ঞেস করা হলো রাখা হবে কোথায়, হুমায়ূন আহমেদ বললেন নূর ভাইয়ের বাড়িতে বড় একটি ডিপ ফ্রিজ কিনে রেখে এসেছি। সেখানে কুকুরগুলোকে রাখা হবে। এরপরে এতো ফোন আসতে লাগলো, সবাই জানতে চায় আপনার বারীতে নাকি ম’/রা কু’কুর রাখা হয়েছে? আমি এতো ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে না, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। কেউ বিশ্বাস করে না।’
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আসলে হুমায়ূন আহমেদ এমনভাবে কথা বলতেন যে সেটা একদম বিশ্বাসযোগ্য। সে সময়ে স্বাধীনভাবে এমন কাজ করার সুযোগ ছিল না কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ যা বলতেন তা করতেন। আমাকে প্রায়ই বলা হয় নুহাশল্লীতে যাওয়ার জন্য, কিন্তু নুহাশপল্লীতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই, হয়তো কোনোদিনই সেখানে যাব না।’
কথা শেষ করে কিছুটা নীরব আসাদুজ্জামান নূর। এরপর বললেন, আমি একটি কবিতা পড়ে শেষ করবো- তারপর দরাজ কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন-
একদিন তরীখানা থেমেছিল এই ঘাটে লেগে,
বসন্তের নূতন হাওয়ার বেগে।
তোমরা শুধায়েছিলে মোরে ডাকি
পরিচয় কোনো আছে নাকি,
যাবে কোন্খানে।
আমি শুধু বলেছি, কে জানে।
নদীতে লাগিল দোলা, বাঁধনে পড়িল টান,
একা বসে গাহিলাম যৌবনের বেদনার গান।
সেই গান শুনি
কুসুমিত তরুতলে তরুণতরুণী
তুলিল অশোক,
মোর হাতে দিয়ে তারা কহিল, “এ আমাদেরই লোক।’
আর কিছু নয়,
সে মোর প্রথম পরিচয়।
তার পরে জোয়ারের বেলা
সাঙ্গ হল, সাঙ্গ হল তরঙ্গের খেলা;
কোকিলের ক্লান্ত গানে
বিস্মৃত দিনের কথা অকস্মাৎ যেন মনে আনে;
কনকচাঁপার দল পড়ে ঝুরে,
ভেসে যায় দূরে–
ফাল্গুনের উৎসবরাতির
নিমন্ত্রণলিখন-পাঁতির
ছিন্ন অংশ তারা
অর্থহারা।
ভাঁটার গভীর টানে
তরীখানা ভেসে যায় সমুদ্রের পানে।
নূতন কালের নব যাত্রী ছেলেমেয়ে
শুধাইছে দূর হতে চেয়ে,
“সন্ধ্যার তারার দিকে
বহিয়া চলেছে তরণী কে।’
সেতারেতে বাঁধিলাম তার,
গাহিলাম আরবার–
মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়,
এই হোক শেষ পরিচয়।
কবিতা শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই কিন্তু তারপরও, বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সেই সময়ও বিরাজ করছিল পিন ড্রপ নীরবতা। হয়তো সেই কবিতার লাইনগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে অনেক অনেক না বলা কথা, যেখানে অমলিন হয়ে আছে নানা ধরনের অব্যক্ত শব্দ, যেখানে মিশে রয়েছে অনেক প্রাণবন্ত স্মৃতি, তিনি অনেক কিছু হয়তো সহ্য করতে পারবেন না – হয়তো তার কারণেই তিনি তার প্রিয় এই বন্ধুর সমাধিস্থলে নিজেকে নিয়ে যেতে চান না। তিনি সমুন্নত রাখতে চাইছেন উজ্জ্বল, তাজা স্মৃতি। অনেকে বন্ধুর বিয়োগ মেনে নিতে পারেন না, অনেকে হয়তো অনেক দিনে ভূলতে পারেন না, বন্ধুর স্মৃতি।