আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল একতরফা হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বিপুল সংখ্যক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার ও সাজা দিয়ে আরেকটি একতরফা নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে সরকার। এই পর্যায়ে বিএনপিকে নির্বাচনের জন্য ডাকা মানে ‘গরু মেরে জুতা দান’। শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে ওয়াইডব্লিউসিএ কনফারেন্স হলে গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের পরিবেশ: প্রত্যাশা, বাস্তবতা ও কর্ম’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে বেসরকারি সংস্থা ”দি হাঙ্গার প্রজেক্ট”। ভোটার সচেতনতা ও নাগরিক সক্রিয়তা প্রকল্পের অধীনে অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম মজুমদার। অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ব্রতী শারমিন মুরশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগামীতে আমরা একটি ইউনিক নির্বাচন দেখতে পাচ্ছি। যেমন খুশি তেমন নির্বাচন আরকি। আমরা এখন ঘোরতর সংকটে আছি। পত্রিকার খবরে দেখতে পেয়েছি কিংস পার্টি তৈরি করা হচ্ছে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য। এদেরকে নিয়ে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে এমন কথাও বলা হচ্ছে।
আজকাল নতুন কিছু শুনছি। সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে এমন অনেকেই বলছেন এবং কমিশনের কেউ কেউও বলছেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে ভোটারদের অংশগ্রহণ। কোন রাজনৈতিক দল আসুক বা না আসুক সেটা দেখার বিষয় নয়- এটা করলেও ভালো বলতাম। কিন্তু এখানে ভোটারদের উপস্থিতি কতটা? তবে যে প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে তাতে হয়তো নির্বাচন হবে, কিন্তু নির্বাচনের পর কী হবে, তাতে আমি সন্দিহান।
সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে উল্লেখ করে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বাড়ি থেকে বের হলেই মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি ভোট দিতে ভোট দিতে পারি না, কী করব? আমি বলি, আল্লাহ আল্লাহ করেন। সরকার ৭ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর বলে মনে হচ্ছে। এটা দিনে দিনে স্পষ্ট যে আরেকটি একতরফা নির্বাচন হচ্ছে। সংলাপের আলোচনা প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখন বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের কথা বলা হচ্ছে।
সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের আহ্বান জানানো হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিরোধী দল চাইলেও নির্বাচন করতে পারবে না। কারণ তাদের সব নেতা এখন কারাগারে। অনেকের সাজা হয়েছে, আরো অনেকের হবে। বেসরকারি সংস্থা ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ বলেন, সরকার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখানে কোনো সংগঠন দাঁড়াতে পারবে না। নির্বাচন কমিশনও শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সুযোগ থেকে কমিশন আমাদের দূরে রাখছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রথম শব্দ ‘গভর্নমেন্ট বাই দ্য ডিসকাশন’। তাই সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে। সংলাপের বিকল্প নেই। সংলাপ শেষ হওয়া মানেই গণতন্ত্রের মৃত্যু। কোনো অবস্থাতেই হতাশ হওয়া উচিত নয়। সংলাপের সম্ভাবনা কখনো শেষ হয় না।
তিনি আরো বলেন, ‘যদি ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে সংলাপ হতে পারে, তাহলে আমরা এখানে কেন সংলাপ করতে পারব না? আদিবাসী সংগঠক সঞ্জীব দ্রং বলেন, বাংলা ভাষায় চশমখোর বলে একটি শব্দ আছে। আমাদের গারো অভিধানে এই শব্দটি নেই। এখন আমরা যখন নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছি, সেখানে কিছু প্রার্থী রয়েছে যারা মুখ থুবড়ে পড়ছে। অল্প টাকা ও অন্যান্য প্রলোভনে প্রার্থীরা একতরফা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তবে আমরা যেন কথা বলা বন্ধ না করি। কথা বলা চালিয়ে যেতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সরকার এখন উন্নয়নের কথা বলছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কথা জানতে চাইলে তারা মুখ খুলতে পারছেন না। সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের পর একাই আরেকটি নির্বাচন করতে চায়। নির্বাচনে তাদের জন্য হুমকি হতে পারে এমন কাউকে ভোটকেন্দ্রে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে নির্বাচন কীভাবে হবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে আমি আশাবাদী হতে চাই। মানুষ এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে। আমি বিশ্বাস করি পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।