বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাইরের প্রভাবের সবচেয়ে বড় উদাহরণ ভারত। নির্বাচন নিয়ে ভারত যে কিছু বলছে না সেটাও একটা বার্তা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোনও অভিনন্দন বার্তাও আসেনি, এমনকি তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসনও নয়। বাংলাদেশে যত গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হবে, চীনের প্রভাব এখানে ততই বিস্তৃত হবে। বিশিষ্ট প্রফেসর আলী রিয়াজ, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউএসএ, রবিবার (১ অক্টোবর) সকালে অনুষ্ঠিত ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের বিশেষ ওয়েবিনার “বাংলাদেশ নির্বাচনে বৈদেশিক শক্তির প্রভাব” শীর্ষক প্রধান বক্তা হিসেবে এমন মন্তব্য করেছেন।
আরেকজন বক্তা, সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো ড. শ্রীরাধা দত্ত অধ্যাপক আলী রিয়াজের সাথে একমত পোষণ করে বলেন, নির্বাচন নিয়ে ভারতের কথা না বলাটাও একটা অবস্থান। নিজেরা ঠিক না থাকলে বাইরের লোক কথা বলার সুযোগ পায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, দিল্লিতে যে সরকারই থাকুক না কেন, তারা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে একইভাবে কাজ করে। আওয়ামী লীগ যা কিছুই করুক না কেন, ভারত তা সামাল দেবে বলে বাংলাদেশে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে কেউ ভোট দিতে পারবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর কারণ হলো সেখানে আগে থেকেই বোঝাপড়া ছিল। ভারত ও চীন নির্বাচন মেনে নিলেও যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই এ নিয়ে কথা বলে আসছে। যে সরকারই আসুক বাংলাদেশ-ভারত একসাথে কাজ করতে পারবে আশাপ্রকাশ করে তিনি বলেন, ভারত চাইবে ২০২৪ সালে এই সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক মো. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অসাংবিধানিকভাবেই পাশ হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা। সম্পূর্ণ বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার টিকে আছে। প্রধানমন্ত্রী চাইলেও দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
ভোটাধিকার বঞ্চিত মানে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানবাধিকার কারো অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির স্পন্দন গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা হস্তক্ষেপ নয়। এগুলো তাদের মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতির অংশ। কিন্তু তাদের কথা না শুনে আমরা অনেক শত্রু তৈরি করেছি। জনগণ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, কারণ জনগণও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ আইন লঙ্ঘন করে গঠিত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই কমিশন একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নয়। তারা সব দলে পরিণত হয়েছে, নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। ২০১৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল না। সে সময় প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কী হয়েছে তা আমরা দেখেছি।
বিশিষ্ট সাংবাদিক মনির হায়দারের পরিচালনায় ওয়েবিনারের আরেক প্যানেলিস্ট, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক হিসেবে দেখতে চায়। আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘাটতির কারণে বাইরের কথা শুনি। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সংকুচিত হবে বলেও মনে করিয়ে দেন তিনি। তিনি আরও মনে করেন যে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে আসার পর বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হবে তা মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যমত্য প্রয়োজন।