বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চাপ্পু। আর তাকে নিয়ে এখনো সারা দেশে চলছে নানা ধরনের আলোচনা। এ দিকে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তিনি অর্পিত দায়িত্ব থেকে পিছপা হবেন না। নির্বাচনের আর মাত্র ১০ মাস বাকি। এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দিকে নজর দেওয়া। যা সারা বিশ্বে স্বীকৃত হবে।
সোমবার যমুনা টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। নতুন রাষ্ট্রপতি আরো বলেন, অরাজনৈতিক দাবি করে বা সংবিধানের বাইরে দাবি করে কিছু করা সম্ভব নয়। আমরা সংবিধানের আলোকে কাজ করতে বাধ্য। আগের সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই সমস্যাটি বিলুপ্ত করা হয়। এখন এটা সংবিধানের অংশ নয়। তাই এখন সংবিধানে যা আছে তা থেকেই সব দলকে অংশগ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় স্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচনের সময় রাষ্ট্রপতির কিছু দায়িত্ব রয়েছে। অর্থাৎ কমিশনকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে বাধা দেয় এমন প্রতিবন্ধকতা দূর করা। নির্বাচনের পরিবেশ সুষ্ঠু ও সুন্দর রাখা। আমি এই দায়িত্ব থেকে পিছপা হব না।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এটি (ইসি) সম্পূর্ণ স্বাধীন। ইসি গঠন প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)সহ অন্যান্য কমিশনারদের ‘পূর্ববর্তী রেকর্ড’ যাচাই করে সার্চ কমিটি মনোনীত করেছে। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে। গাইবান্ধার নির্বাচন তাদের সহজাত ক্ষমতাকে বাতিল করে দেয় কারণ তাদের স্বাধীনতা রয়েছে। আওয়ামী লীগের কিছু বলার থাকলেও তা বলেনি। কারণ ইসি যা ভেবেছে, স্বাধীনভাবে তারা তাদের অধিকার প্রয়োগ করেছে। তাই আমি মনে করি, জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে সংঘাত ভুলে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো সংঘাতে না গিয়ে জান-মালের ক্ষতি না করে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারলেই এদেশের কল্যাণ। এ প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐক্য তৈরি হবে। জনগণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাবে। (অতঃপর) দেশে একটি সত্যিকারের এবং শক্তিশালী সরকার জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হবে। (যেহেতু) সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে জনগণই দেশের মালিক। তাহলে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের পক্ষে জনগণের ভালো-মন্দ দেখা সম্ভব।
নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হতে হবে- এটা শুধু সরকারের কাম্য নয়, দেশ তথা সারা বিশ্বের মানুষেরও কামনা। ছোট দল, বড় দল, জোট- সবাইকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারলেই নির্বাচনে আসা তাদের (দলগুলোর) স্বার্থে। তারা (বিরোধী দল) সংবিধান সংশোধনসহ নানা যুক্তি দেখান। যারা তর্ক করে তারা তাদের যুক্তি। আমি এর সাথে তর্ক করব না। কিন্তু সংবিধানের মধ্যেই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে। সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন করতে চাই। এ ক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে ইসিকে দেওয়া ক্ষমতা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করা। এবং এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যেমন: জাতীয় বিপর্যয়, নির্বাচনী নৈরাজ্য বা নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করা। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশের জন্য রক্ত দিয়েছি। আমি এই বিষয়ে কিছু চিন্তা আছে. আর তা হলো, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বা নৈরাজ্য দূর করার চেষ্টা করা হলে যে ভূমিকা পালন করা দরকার আমি তা পালন করব। তবে আমি একটি সুষ্ঠু কর্মসূচির মাধ্যমে আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চাই। যাতে কোনো পক্ষপাতিত্বের চিহ্ন না থাকে। জনগণকে বুঝতে হবে (সেটা দেখে) রাষ্ট্রপতি যে কাজ করেছেন তা দেশের জন্য করেছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আমার দায়িত্ব পালন করা হবে। কাউকে নিপীড়ন বা ‘অপরাধ’ করার জন্য নয়। ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধী দলের যেকোনো ‘ভিকটিমাইজেশন’ (ক্ষতিগ্রস্ত) হতে পারে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন চাই।
নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সংক্ষিপ্তভাবে তার ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িত থাকার দীর্ঘ ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বাকশালের সাথে তার সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, আমি রাজনীতি করেছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ যখন আমাকে একটি বড় দায়িত্ব অর্পণ করেছে, তখন আমার প্রথম কাজ এখন জাতীয় বিভেদকে ঐক্যে পরিণত করা। আমার কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতা নেই। আমি মনে করি, সবার সহযোগিতায় দেশ ও জনগণের অগ্রগতি হতে হবে।
বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে জনগণের জন্য কাজ করার জন্য সবাইকে একত্রিত করার চ্যালেঞ্জ কীভাবে নেওয়া যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ না থাকা দুর্ভাগ্যজনক। বাঙালিরা জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে ঐক্য করতে পারিনি। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলতে লজ্জাবোধ করেন। স্বীকৃত বিষয়ে অনীহা থাকলে ঐক্যবদ্ধ জাতি সম্ভব নয়। তবে জাতীয় ঐক্য দরকার। যারা পৃথিবী থেকে একটি দলকে মুছে ফেলতে চায়, যেমন: ১৯৭৫ সালের ২১ আগস্ট, ১৫ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। জাতির পিতা সারা জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, শুধু তিনিই নন, তাঁর পুরো পরিবার শহীদ হন। এ দেশে এমন বর্বরতা সম্ভব! মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা এটা কল্পনাও করতে পারিনি। এই জাতির এমন অভিজ্ঞতা আছে। তারপর থেকে আমাদের উচিত ছিল তাদের বিচারের আওতায় আনা। আইনের গতিতে বিচার করলে দেশ চলবে। কিন্তু তা না করে ক্ষতিপূরণসহ পুরস্কার পোস্ট করে দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছে। তাহলে কি তারা এই হত্যাকাণ্ডের অংশীদার নয়?
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন, এমন সময় বলা উচিত নয়। কিন্তু আমি আমার ‘কংস’ (চেতনা) এর সাথে ‘বিত্রে’ (বিশ্বাসঘাতকতা) করতে পারি না। সত্য বলতে আমার আপত্তি নেই। ক্ষতিপূরণ দেওয়া, তাদের রক্ষা করার চেষ্টা একটি সভ্য দেশে কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর এখানেই শেষ নয়, যারা আগস্ট করেছিল, তারা এবং মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি মিলে দেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় নিয়ে গিয়েছিল। তারা স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি। তাই যে দেশে এই মানসিকতা থাকবে সেখানে এটা (ঐক্য) হবে না। তবে এর জন্য আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা বিনিয়োগ করতে হবে।
তিনি বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যে সহিংসতা হয়েছিল তাও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি বড় উদাহরণ। আমি ওই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলাম। রিপোর্ট দিয়েছি। আমার শরীর কেঁপে উঠল। বঙ্গবন্ধু কন্যা ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তিনি প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ মিছিল করেনি। অস্ত্র তোলা তো দূরের কথা, বিজয় মিছিল নিষিদ্ধ করলেন। তিনি তাদের স্বর্গে রেখেছিলেন। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তারা স্বর্গে আছে। তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি। এটা যাতে তারা অনুতপ্ত হয়।
তার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, “আমি সৃষ্টিকর্তা, পরম করুণাময়, আল্লাহ তায়ালাকে ধন্যবাদ জানাই।” এছাড়াও, আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির প্রধান ও সংসদ নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী, জাতীয় ধনকুবের ও দূরদর্শী নেত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি আমাকে এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা সংসদ নেতার পূর্ণ বিবেচনা। যেখানে সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন, সেখানে পত্রিকায় বিষয়টি দেখতাম। আমি সব জায়গায় বিভিন্ন খবর জানতাম. যেহেতু আমি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলাম। এছাড়াও আমি প্রচার ও প্রকাশনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। পার্টি অফিসে যাওয়া-আসা করতেন। অনেক আলাপ-আলোচনা শুনতাম। কিন্তু আমি সেখানে কখনো আঁচ করতে পারিনি যে, আমি কোনো বিষয়বস্তু হতে পারি। এতটুকু ভাবনাও আমার মধ্যে ছিল না।
প্রসঙ্গত, এ দিকে পাবনার ছেলে দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হয়েছে বলে সেখানে এখন বইছে আনন্দের বন্যা। সব কিছু হয়ে আছে ঠিক। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে তার হাতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়ার বিষয়টি বাকি রয়েছে।