নির্বাচন কমিশনের সাথে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় বসেছে, কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ অন্য চারটি দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম মেশিন এর মাধ্যমে ভোট গ্রহনের বিষয়ে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে বাকি যে ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে, তার বেশিরভাগই ইভিএম মেশিন ভোটের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বাধিক ১৫০ টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন এর ব্যবহার করা হবে এমনটাই জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনের প্রধান স্টেকহোল্ডার বা অংশীদার হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলসমূহ। কোন পদ্ধতিতে ভোট নেওয়া হবে—সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের থাকলেও যে পদ্ধতি বা মেশিন নিয়ে অধিকাংশ দলের অনাস্থা ও সংশয় রয়েছে—নৈতিকভাবে ইসি সেই পদ্ধতিতে ভোট নিতে পারে কিনা বা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর মতামতকে উপেক্ষা করার অধিকার তাদের রয়েছে কিনা—সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
কেন ইভিএম? চলুন একটু পেছনে তাকাই।
ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে দেশের প্রথম ইভিএম ভোট নেওয়া হয় এবং সেখানে মেশিনের সাফল্য মূলত দ্রুত গণনার গতির কারণে সবাইকে অভিভূত করে। ভোটগ্রহণের আধা ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল ঘোষণা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় এবং মেশিনে কারচুপির কোনো অভিযোগ ছিল না।
২০১০ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে এই মেশিন ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো বড় আকারে ভোটগ্রহণ করা হয়। কিন্তু ওই কেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। ২০১৩ সালের ১৫ জুন রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে সবচেয়ে জটিলতা ছিল। জটিলতার কারণে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে দ্বিতীয়বার নির্বাচন করতে হয়। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে ইভিএম বিকল হয়। এরপর যতবারই ইভিএম ব্যবহার হয়েছে ততবারই কমবেশি বিতর্ক হয়েছে।
এই মেশিনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল দ্রুত ভোট গণনা। আর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এই মেশিনে বেশির ভাগ মানুষই ভোট দিতে অভ্যস্ত নয়। ফলে ধীরগতিতে চলছে ভোট গ্রহণ। এমনও অনেক অভিযোগ রয়েছে যে বুথের ভিতরে কিছু লোক তথাকথিত সহায়তার নামে নির্দিষ্ট প্রার্থীর মার্কায় টিপ দিতে বাধ্য হয় কারণ অনেক সময় বৃদ্ধ ও অশিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষ এসব মেশিনে সঠিকভাবে ভোট দিতে পারেন না। এসব কারণে ইভিএম নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়েনি।
গত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারও ইভিএম কারচুপির অভিযোগ করেন। তিনি ইভিএমকে ‘প্রতারণার বাক্স’ হিসেবে অভিহিত করে দাবি করেন, পুলিশ, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন প্রকৌশলের মাধ্যমে তাকে পরাজিত করেছে।
এমন বাস্তবতায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্প্রতি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসির যে সংলাপ হয়েছে, তাতে সরকারের বাইরে থাকা দলগুলো মূলত দুটি বিষয়ে তাদের মতামত জানিয়েছে; ১. নির্বাচন নিরপেক্ষ সরকার এবং ২. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করা। তবে নির্বাচনী সরকারের নামে সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তারা তিনশ আসনেই ইভিএমের পক্ষে।
মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে চায় তারা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বুধবার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে গণমাধ্যমকে বলেন, “সংলাপে ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা থাকলেও তাদের বক্তব্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আমরা নিজেরাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভোট সুষ্ঠু করতে ভোটাধিকার প্রয়োগের কথা মাথায় রেখেই ইভিএমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনকালীন জোটের শরিক জাতীয় পার্টি (এরশাদ) এবং ক্ষমতাসীন ১৪ দলের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)ও ইভিএম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। আর কমিশনের সংলাপে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশ না নিলেও তারা দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু গত ৭ মে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে তারা। তার মানে এটা পরিষ্কার যে সব রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিপক্ষে থাকলেও ক্ষমতাসীন দল যেহেতু ৩০০ আসনেই ইভিএম চায়, তাই ইসির ওপর একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে।
সিইসির ভাষায়, ‘রাজনৈতিক দল নয়, ভোট পরিচালনা করবে ইসি। নির্বাচন করা ইসির বড় দায়িত্ব। ভোট যাতে আরও স্বাচ্ছন্দ্য, সুষ্ঠু হয় তা নিশ্চিত করবে ইসি। যারা ভোট দিতে আসবেন, সেটাই আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। রাজনৈতিক দলগুলো যা বলেছে তা আমাদের মূল বিবেচনায় আসেনি। ইভিএম নিয়ে সংশয় বা এ মেশিনের মাধ্যমে কোনো কারসাজি হয়েছে কিনা তা ভোটের পর বোঝা যাবে বলেও মন্তব্য করেন সিইসি।
প্রশ্ন হলো, ভোটের পর কারচুপি হয়েছে বোঝা গেলে ইসি কী করবে? ভোট বাতিল করে আবার ব্যালট পেপারে ভোট? অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠলেও এবং নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা হলেও সেগুলো নিষ্পত্তির আগেই আগামী নির্বাচনের তারিখ ঘনিয়ে আসে। তাই ইভিএমে ভোট দেওয়ার পর যদি বিপুল সংখ্যক আসন থেকে অভিযোগ ওঠে, তবে কারচুপি বা জালিয়াতি হয়েছে কিনা তা প্রমাণ করার এবং প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সময় আসবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।
সমস্যাটি হল ব্যালট বাক্স লুট করা, আগের রাতে সিল করা ব্যালটে বাক্সগুলি ভর্তি করা এবং দ্রুত ভোট গণনা এবং ঘোষণার সুবিধার কথা মাথায় রেখে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম চালু করার সময়ও রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মতো পরিস্থিতি এড়ানো। ফলাফলের শেষ নেই। কারণ তা হয়নি, ইভিএমও বিতর্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি।
তবে, নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে যে ইভিএমে কারচুপি বা জালিয়াতির সুযোগ নেই এবং তারা মেশিনে ত্রুটি সনাক্ত করার চ্যালেঞ্জও জানিয়েছে। তাই যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া হয় যে ইভিএম ত্রুটিপূর্ণ বা কারচুপির নয়, নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত বেশিরভাগ প্রধান রাজনৈতিক দল এই মেশিনের বিরুদ্ধে থাকলেও; যদি মেশিনটি সব প্রার্থীর আস্থা অর্জন করতে না পারে এবং প্রার্থীদের মধ্যে যদি ইভিএমএ কারচুপি হতে পারে এমন ধারণা তৈরি হয়, তাহলে ভোট যতই শান্তিপূর্ণ হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য হবে না।
ভোট যতই শান্তিপূর্ণ হোক, ভোট যতই ভোটদান হোক বা যতই অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর হোক না কেন, যে মেশিনে মানুষ ভোট দেয় সেটি যদি সবার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তাহলে ভোট বিশ্বাসযোগ্য নয়। এরপরও বিপুল সংখ্যক মানুষ ইভিএমে ভোট দিতে আসার পর সন্দেহে আছে যে তারা যে তরমুজ মার্কায় ভোট দিয়েছেন সেটি তরমুজ মার্কা নাকি কলা মার্কা? এই অবিশ্বাস, এই সংশয় ভোটারদের মধ্যে। তবে ভোটারদের এই আস্থা, অবিশ্বাস ও সংশয় দূর করতে এবং এই মেশিনে সহজে ও দ্রুত ভোট দিতে খুব বড় পরিসরে কোনো উদ্যোগ নেয়নি নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের বেশ কিছু দিন আগেও সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটারদের কাছে মেশিনের ব্যাপক প্রচার বা হাতে-কলমে শেখানো হয় না।
তাই মেশিন হিসেবে ইভিএম যতই উন্নত ও সুরক্ষিত হোক না কেন – নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল যদি মেশিনের ওপর আস্থা না রাখে এবং নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে ঐকমত্য না থাকে, তাহলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য বড় আকারে ইভিএম ব্যবহার করার কোনো মানে হয় না।
সব মিলিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত কতটি আসনে ইভিএম ব্যবহার হবে তা এখনই সিদ্ধান্তে আসা কঠিন। কারণ রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই, যেহেতু আগামী নির্বাচনের এখনও প্রায় এক বছর চার মাস বাকি, এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়; ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও তাদের জোট এই ইস্যুতে জনগণের দাবি সামনে আনতে পারবে এবং সরকার ও ইসি কতটা দাবি পূরণ করতে পারবে- তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।তবে এটা ঠিক, নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপি ও তার শরিক বা সমমনা দলগুলোর প্রধান দাবি যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার, তার সঙ্গে এবার এই ইভিএমেএ ভোট না দেয়ার দাবিটিও যুক্ত হবে এবং আগামী দিনগুলোয় তারা এই ইস্যুতেও ‘জ্বালাময়ী’ বক্তব্য দেবেন।
যদিও এ বিষয়ে সংকট থাকবে- সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ বলতে পারব না। আপনি বিগত ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনেও সংকটের কথা বলেছেন। আগামী নির্বাচন নিয়ে সংকট হবে কিনা তা বলা যাচ্ছে না।
সিইসি এ কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন, কী করলে কী হয় বা হতে পারে; রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফলে দেশে কী ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে তা অনুমান করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের থাকতে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো নির্বাচন কমিশন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারবে কি? তবে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন কতটুকু নিরপেক্ষতা থাকবে সেটাও জনসাধারণের প্রশ্ন থেকে যায়। তবে একটা বিষয় দেখা যাচ্ছে, দলীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। তাই নিরপেক্ষতা কতটা আসতে পারে সেটা অনেকটাই বুঝতে পারছে সাধারণ মানুষ। নির্বাচন কমিশন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাবস্থা করে জনগণের স্বার্থে কাজ করা উচিত।
লেখনীতে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক, নেক্সাস টেলিভিশন।