নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে আর মাত্র দশ দিন বাকি রয়েছে। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা দুই হেভিওয়েট প্রার্থী হলেন তৈমুর আলম খন্দকার এবং সেলিনা রহমান। এই দুই প্রার্থী নির্বাচনে বিজয়ী হতে বেশ জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের সমর্থক নেতাকর্মীরা তাদের মনোনীত প্রার্থীকে জয়ী করতে মাঠে নেমে কাজ করে যাচ্ছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য পদ থেকে তৈমুর আলম খন্দকার কে অব্যাহতি দেয়ার পর তিনি তার রাজনৈতিক দলের সমর্থন থেকে অনেকটা পিছিয়ে গেলেন। তবে তার নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীরা তার পক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানা গিয়েছে। এদিকে সাবেক মেয়র ও আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী আইভিকে তার দল থেকে সমর্থন করলেও তার নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য শামীম ওসমান তাকে সমর্থন দেয়া থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। সেই দিক থেকে ধরে নেওয়া হচ্ছে যারা শামীম ওসমানের কাছের লোক কিংবা তার সমর্থকেরা তাদের অনেকেই পিছিয়ে যেতে পারেন। তৈমুর আলম খন্দকার বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর বিএনপির অনেক নেতাকর্মী সুযোগ পেয়েছেন, সেই দিক থেকে তারা এই নেতার পক্ষে কাজ করা থেকে অনেকটাই পিছিয়ে যাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১১ সালে ভোটের মাত্র ৮ ঘণ্টা আগে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারকে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল দল থেকে। কিন্তু এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও নিজ দলের কেন্দ্র থেকে রীতিমত ‘হঠকারিতা’ ভরা নানামুখী সিদ্ধান্ত আসছে অ্যাডভোকেট তৈমুরকে নিয়ে।
এদিকে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশও পরোক্ষ প্রত্যক্ষভাবে বিরোধিতা করছেন তৈমুরের নির্বাচন করাকে নিয়ে। অপরদিকে সরকারদলীয় প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াত আইভির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সমর্থন থাকলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগে একটি বড় অংশ তার পক্ষে থাকবে না, এমনটা নিয়েই চলছিল আলোচনা-সমালোচনা।
বিশেষ করে প্রভাবশালী নেতা ও এমপি শামীম ওসমান ভোটের বাইরে থাকলেও কর্মী-সমর্থকরা মনে করছেন সরকারদলীয় প্রার্থীর জয় পরাজয়ের ক্ষেত্রে অন্যতম ইস্যু তিনি। যদিও এখনও পর্যন্ত নাসিক নির্বাচন ইস্যুতে মুখ খুলছেন না তিনি।
আর দলের বাইরে সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন নিজেদের দল নিয়ে উভয় সংকটে আছেন এই উভয় হেভিওয়েট প্রার্থী।
তবে তৈমুর বলছেন তার ক্ষেত্রে দলীয় প্রতীক না থাকায় তিনি এখন মুক্ত, তিনি এখন জনতার। আর আইভী বলেছেন, দলীয় প্রতীকই তার জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ। অনেক জায়গায় ভোটারদের বোঝাতে হচ্ছে আইভির মার্কা নৌকা।
জানা গেছে, নাসিক নির্বাচনে তৃনমূল থেকে কেন্দ্রে পাঠানো মেয়র পদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় ডাঃ সেলিনা হায়াত আইভীর নাম ছিল না। সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামীলীগের কার্যকরী কমিটির প্রায় অর্ধশত সদস্য ও ২৬টি ওয়ার্ডের নেতাদের নিয়ে গঠিত নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রায় ৫০ সদস্যের বিশেষ বর্ধিত সভায় এ তালিকা পাঠানো হয়।
তবে শেষ পর্যন্ত সেলিনা হায়াৎ আইভীকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয় দল। ফলে শুরু থেকেই দলের একাংশের মাঠে নামা নিয়ে সংশয় থাকলেও শেষ পর্যন্ত সবাই নৌকার পক্ষে মাঠে নামেন। এমনকি সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা হকার সংঘ’/র্ষের ঘটনাসহ ব্যক্তিগত কারণে সিটি করপোরেশন ও আইভীর দায়ের করা মামলাযর পর নৌকা প্রতীকের পক্ষে নেমেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড.খোকন সাহাসহ সহযোগী সংগঠনের আসামী হওয়া শীর্ষ নেতারাও।
বিশেষ করে শামীম ওসমানপন্থী হিসেবে পরিচিত সকল শীর্ষ নেতা ও কর্মীরাও অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন নৌকার জন্য। গত সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ আসছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচন (নাসিক) পরিচালনা কমিটির নেতারাও।
তবে দলীয় নেতাকর্মীরা সাংগঠনিক শাস্তির কথা ভেবে সরাসরি মুখ না খুললেও সরকারদলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভির বেশ কিছু বক্তব্যে ক্ষো’ভ জানিয়েছেন অনেকেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের একাধিক প্রবীণ নেতারা জানান, বিভেদ-ক্ষোভ ভুলে সব নেতাকর্মীরা একযোগে নৌকার জয় নিশ্চিত করতে মাঠে নামলেও আইভির কিছু বক্তব্য আমাদের ব্যথিত করছে। বিশেষ করে তৃনমূলের কর্মী সমর্থকরা বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন করছে।
নেতারা বলেন, যে নৌকার প্রশ্নে আমরা এক পতাকা তলে দাঁড়িয়েছি সেই নৌকা পাওয়ার পর আইভী বলেছেন ‘ আইভির মার্কা আইভীই’। বিভিন্ন গণসংযোগে গিয়ে তিনি বলছেন, নৌকার প্রার্থী হলেও তার কাছে সব দলমতের লোকেরা সমান। সর্বশেষ মঙ্গলবার সিদ্ধিরগঞ্জে প্রচারণায় গিয়ে আইভী বলেছেন নৌকা প্রতীক তার জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ। অনেক জায়গায় গেলে মানুষ নাকি তাকে প্রশ্ন করে। তিনি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তারা মার্কা নৌকা, এটা জাতীয় নির্বাচন না। তাই প্রতীক নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না।
প্রবীণ নেতৃবৃন্দ আক্ষেপ জানিয়ে বলেন, ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকেও কোথাও বলতে শুনিনি নৌকা নিয়ে নির্বাচন করা চ্যালেঞ্জের। সেখানে আইভী নৌকার সাথে নিজের ইমেজকে সমকক্ষ করে বক্তব্য দিয়ে আমাদের হৃদয়ে ক্ষরণ ঘটাচ্ছেন। তাকে ভুলে গেলে চলবে না, কেন্দ্রীয় নেতারাও আসছেন নৌকাকে জেতাতে, আইভীকে নয়।
অপরদিকে বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামার পরপরই নিজের দল থেকেই একের পর এক দ্বিধাদ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছেন। তৈমুরের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মাঠে নামার পরপরই ভেঙ্গে পরা সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয় এখানকার নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে গত ১৬ ডিসেম্বর ১৫ বছরের ব্যবধানে স্মরণকালের বিশাল শোডাউন দেয় বিএনপি। দলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি তৈমুরের পাশে দেখা মিলে সাধারণ মানুষের ঢল।
কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয় গত ২৫ ডিসেম্বর। ওই দিন তাকে জেলা বিএনপির আহবায়ক পদ থেকে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক মনিরুল ইসলাম রবিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনার ৯ দিন পর গত সোমবার বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পদ থেকে তাকে সরানো হয়।
এসব নিয়ে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও বেশ উৎফুল্লতা দেখা দিলেও স্থানীয় বিএনপির নেতাকার্মীরা মনে করছেন এটি বিএনপির নির্বাচনী কৌশল। কারণ ইতিমধ্যেই দলের মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর টেলিফোনে তৈমুরের পক্ষে মাঠে থাকার ব্যাপারে ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, তৈমুরের জয় মানেই জনতার জয়।
মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামাল জানান, যেহেতু কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত রয়েছে এই সরকারের আমলে নির্বাচনে অংশ নিবে না, তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৈমুরকে সরাসরি সমর্থন দিতে পারেনা বিএনপি। স্বতন্ত্র হিসেবে জনতার প্রার্থী হিসেবে নিশ্চিত করতেই তাকে দলের ২টি পদ থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, দলের পদ থেকে সরিয়ে দিলে নিশ্চয়ই বিএনপি নেতাকর্মীরা নৌকাতে ভোট দিবেন না। তৈমুরের বিজয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত দৃঢ় বলেই কেন্দ্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে সাধারণ মানুষ দলীয় প্রতীকের ঝামেলায় না পরেন। যদিও জেলা বিএনপির একটি অংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তৈমুরের বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করা উচিত হয়নি তৈমুরের।
ইতোমধ্যেই সিদ্ধিরগঞ্জের সাবেক বিএনপিদলীয় এমপি গিয়াস উদ্দিনের ছেলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর (সদ্য সাবেক) সাদরিল নিজেই সরকারদলীয় প্রার্থী আইভির সঙ্গে প্রচারণা করেছেন, নৌকায় ভোটে চেয়েছেন।
মামুন মাহামুদ যিনি জেলা বিএনপির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন তিনি বলেছেন, বিএনপি এই নির্বাচনের বাইরে রয়েছে, এটা বোঝানোর জন্য তৈমুর আলমকে তার বিএনপির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এদিকে অন্যদিকে যে অভিযোগ উঠেছে সেটাও আলোচনায় এসেছে। সেটা হলো সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াসের যারা কর্মী সমর্থ তারাও এবার ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করতে মাঠে নেমেছেন। তার নৌকার পক্ষ নিয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন। অবশ্য জানা গেছে গিয়াস উদ্দিনের সাথে গনমাধ্যমের কর্মীরা এবং তার পক্ষে কাজ করা অনেকেই যোগাযোগ করতে পারছে না গেল ২ সপ্তাহ যাবৎ।
অন্যদিকে তৈমূরকে অব্যাহতি দেওয়ার পর তার বিষয়ে জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতাকর্মী রয়েছেন তারাও তার নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ দিয়েছেন, কারন দলীয় সিদ্ধান্ত বলে কথা। ঐ এলাকার ২ জন প্রথম সারির নেতা নজরুল ইসলাম টিটু, রুহুল আমিন শিকদার দলের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনেক পেছনে সরে গেছেন তৈমুরের থেকে। তবে তারা বলছেন দলীয় কৌশলেই তার প্রতি এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আবার অনেকেই দলের এই সিদ্ধান্ত যারা তৈমুরের হিতাকাঙ্খী নয় তারা কামনা করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা যেমন হঠাৎ করে পিছিয়ে গিয়েছে, সেভাবেই এবার অন্যরাও পিছিয়ে যাক।