২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত, মজিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে নিক্সন, শিবচরের দত্তপাড়া গ্রামের বাসিন্দা এবং ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য। তিনি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তার ভাঙ্গার আজিমপুর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামে তৈরি করা বিশাল বাংলোবাড়ি রাজনৈতিক প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ অনুযায়ী, এই বাংলোবাড়ি শুধুমাত্র একটি বসবাসের জায়গা ছিল না, এটি ছিল ভিন্নমত দমনের ‘টর্চার সেল’।
এই বাড়িতে যারা তার রাজনৈতিক আদেশ অমান্য করতেন, তাদের ধরে এনে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হতো। শীতের রাতে অনেককে বাংলোবাড়ির সামনে থাকা পুকুরে চুবানো হতো এবং কিছু মানুষকে টয়লেটে আটকে রাখা হতো। বাড়ির ভেতরে সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা ভিন্নমতের লোকজনকে শাস্তি প্রদান করা হতো।
নিক্সন চৌধুরীর রাজনৈতিক উত্থান মূলত শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরীর সন্তান হওয়ায় সম্ভব হয়েছে। তার শ্বশুর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, একজন প্রভাবশালী নেতা এবং সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী। শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। যদিও তিনি নিজের মুখে সবসময় বলতেন, “জনগণের ভালোবাসায় আমি এমপি হয়েছি,” বাস্তবে তার ক্ষমতায়ন এবং সাংগঠনিক প্রভাব ছিল ভয় ও সন্ত্রাসের ওপর ভিত্তি করে।
২০১৮ সালে, নিক্সন তার বাংলোবাড়ি নির্মাণ করে শুরু করেন স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কৌশল। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের দলে টেনে নেন এবং নির্বাচনে সহিংসতার মাধ্যমে ভোট ডাকাতি করিয়ে নিজের প্রার্থীদের বিজয়ী করাতেন। নিক্সনের নির্দেশে তার সশস্ত্র বাহিনী অনেককেই ধরে এনে টর্চার সেলে নির্যাতন করত।
বিরোধীদের নিপীড়ন এবং ক্ষমতার কৌশল
নিক্সন চৌধুরী ছিলেন একজন অত্যন্ত কৌশলী রাজনীতিবিদ। প্রথম দিকে তার অধীনস্থ পুলিশ-প্রশাসনের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করতে না পারলেও, পরে ভয় দেখিয়ে এবং অর্থের প্রলোভনে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তার বিরোধীরা তার ক্ষমতার বলয়ে চাপা পড়ে যান, এবং যারা তাকে সমর্থন করতে অস্বীকার করতেন, তাদের বিরুদ্ধে ছিল সহিংস প্রতিক্রিয়া।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ভাঙ্গার যুবলীগ নেতা আরাফাতকে ধরে এনে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হলে তার দমননীতি আরও প্রকাশ পায়। আরাফাতের নির্যাতনের সময় ডিবি পুলিশের ওসি জানান, “আমি নিক্সন চৌধুরীর লোক”। এর মধ্য দিয়ে নিক্সনের স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি আরও পরিষ্কার হয়ে যায়।
জমি দখল এবং ‘আয়মান আইল্যান্ড’
সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর, নিক্সন শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেই থেমে থাকেননি; তিনি শিবচর থেকে ব্রাহ্মণপাড়া পর্যন্ত বিশাল ফসলি জমি দখল করে সেখানে তার বাংলোবাড়ি তৈরি করেন। এই জমিগুলো মূলত ফসলি জমি ছিল, যেখানে স্থানীয় কৃষকরা পটল, ঢ্যাঁড়স, ঝিঙ্গা এবং অন্যান্য সবজি উৎপাদন করতেন। কিন্তু নিক্সন সেগুলো নামমাত্র মূল্যে কিনে এবং অনেক জায়গায় জোরপূর্বক দখল করে সেখানে তার ‘আয়মান আইল্যান্ড’ নামে একটি অঞ্চল তৈরি করেন।
জনগণের মাঝে ভয়
নিক্সনের ক্ষমতার ভয় এতটাই ছিল যে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেত না। শেখ পরিবারের সদস্য হওয়ায় এবং তার প্রভাবশালী সম্পর্কের কারণে তাকে প্রশ্ন করার সাহসও কারও ছিল না। তার প্রতি ভিন্নমত প্রকাশ করলে শারীরিক নির্যাতন, অপমান কিংবা আরও গুরুতর শাস্তির মুখোমুখি হতে হতো।
নিক্সন চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরও কিছু গুরুতর অভিযোগ তুলে ধরা হলো:
ভোট কারচুপি ও সহিংসতা:
নিক্সনের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হলো, স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপি এবং সহিংসতার মাধ্যমে জয়লাভ করা। বিভিন্ন নির্বাচনে তার প্রার্থীদের জেতানোর জন্য প্রশাসনকে প্রভাবিত করা, সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বিরোধী প্রার্থীদের ভয় দেখানো এবং ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। তার মোটরসাইকেল বাহিনী নির্বাচনের সময় বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে হানা দিত এবং ব্যালট পেপার ভরে দিত।
বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের নিপীড়ন:
নিক্সন তার বিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীদের দমাতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন। এর মধ্যে অনেকে স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বা আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও নিক্সনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তাদের ওপরও আঘাত আসতো। যেমন, কাজী জাফর উল্যাহ’র সমর্থক শেখ আরাফাতকে গ্রেপ্তার করিয়ে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানোর ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
প্রশাসনের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ:
নিক্সনের সাথে স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি প্রশাসনকে প্রভাবিত করে নিজের অনুগত লোকদের বিভিন্ন পদে বসাতেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে তার নিজস্ব লোকদের নিয়োগ করতেন। পুলিশ-প্রশাসনকেও নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন গালাগাল ও হুমকির অডিও-ভিডিও ফাঁস হওয়ার ঘটনায়।
টর্চার সেল পরিচালনা:
নিক্সনের ব্রাহ্মণপাড়ার বাংলোবাড়ি নিয়ে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হলো, এটি তার বিরোধীদের জন্য একটি টর্চার সেলে পরিণত করা হয়েছিল। যারা নিক্সনের নির্দেশে কাজ করতে অস্বীকার করতেন বা বিরোধিতা করতেন, তাদের শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হতো। শীতের রাতে পুকুরের পানিতে চুবানো, টয়লেটে আটকিয়ে রাখা, এবং বাড়িতে এনে নির্মমভাবে পেটানো হতো।
ভূমি দখল ও ‘আয়মান আইল্যান্ড’ গঠন:
২০১৪ সালে সংসদ সদস্য হওয়ার পর থেকেই নিক্সন ব্রাহ্মণপাড়ায় বিশাল বাংলোবাড়ি তৈরি করেন। সেখানে হাজার বিঘা জমি দখল করে ‘আয়মান আইল্যান্ড’ নামে একটি জায়গা তৈরি করেন, যেখানে প্লট বিক্রির ব্যবসা চালাতেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ কৃষকদের জমি নামমাত্র দামে কিনে দখল করতেন এবং জমি রেজিস্ট্রির কাজটি নিজের বাড়িতে করাতেন।
নারী ইউএনওকে গালিগালাজ ও হুমকি:
২০২০ সালে চরভদ্রাসন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে নিক্সনের প্রার্থী সুবিধা না পাওয়ায় তিনি মোবাইল ফোনে এক নারী ইউএনওকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। তাকে হুমকি দেন যে, ভবিষ্যতে তার নেতাকর্মীদের কোনো কাজে বাধা দিলে ইউএনও’র হাত-পা ভেঙে দেওয়া হবে। এ ঘটনায় ব্যাপক সমালোচনা হলেও নিক্সনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, নিক্সনের রাজনৈতিক জীবনে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, এবং সহিংসতার প্রভাব কতটা ছিল।