নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৬ ই জানুয়ারি, সেই হিসেবে আর মাত্র ১০ দিন বাকি রয়েছে। ইতিমধ্যে প্রচার-প্রচারণায় মাঠে নেমেছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সকল প্রার্থী। এই নির্বাচনের দুই হেভিওয়েট প্রার্থী হলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং তৈমুর আলম খন্দকার। মেয়র পদে আরও কয়েকজন প্রার্থী থাকলেও এই দুই নেতাই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সামনে থাকবে এমনটি মনে করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী দলীয় সমর্থন পেয়ে বেশ জোরেশোরেই নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে, দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি দলীয় ভাবে নির্বাচনে না আসলেও বিএনপি’র প্রবীণ নেতা তৈমুর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর যদি কারো জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে থাকে, তবে তিনি নির্বাচনে জয়ী হবেন এই আশা নিয়েই নির্বাচনী লড়াইয়ে নিজেকে যুক্ত করেন। তবে সবার নয় জয় একজনেরই হয়ে থাকে। এখন দেখার পালা এই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে কে সৌভাগ্যবান হবেন। সেজন্য আমাদের আরো কয়েকটা দিন ধৈর্য ধরতে হবে।
এবার সেলিনা হায়াৎ আইভী এবং তৈমূর আলম খন্দকার দুইজনই জয়ের আশা ব্যক্ত করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে শুরু করেছেন। দুইজনই জনপ্রিয় মানুষ। আইভী আগে দুইবার সিটি মেয়র পদে জিতেছেন। তৈমূরের ঝুলিতে জয়ের মালা নেই। এবারও দল তার পক্ষে আছে কি না তা স্পষ্ট নয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে তাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আবার তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হননি। স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা তার সঙ্গে আছেন, নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। তৈমূর আলম খন্দকার এখন নিজেকে সব দলের প্রার্থী বলে দাবি করছেন। এই দাবি থেকে অবশ্য এটা বলা যায় না যে, সব দলের ভোটই তিনি পাবেন। ভোট দেওয়ার আগে মানুষ নানা কিছু বিবেচনা করে থাকে। প্রার্থী যেসব ওয়াদা করেন তা পূরণের সাধ্য ও সুযোগ তার আছে কিনা, সেটা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়।
তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলে নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীন সরকারের পতন হবে না। আবার তিনি আওয়ামী লীগের না হওয়ায় তার পক্ষে উন্নয়ন কাজকর্ম এগিয়ে নেওয়া কতটুকু সম্ভব হবে তা-ও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। সবকিছুই হয় দলীয় রাজনৈতিক সুবিধা বিবেচনা করে। ভিন্ন দলের কেউ স্থানীয় সরকারের বড় পদে নির্বাচিত হয়ে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে পেরেছেন, এমন নজির আছে কি? ভোটের আগে এটা কি ভোটারদের বিবেচনার বাইরে থাকবে?
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এবার তৃতীয় বারের মতো নির্বাচন হচ্ছে। এর আগের দুই বারই মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছিলেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। এবারও তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে নৌকা প্রতীকে লড়াইয়ে নেমেছেন। বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী আইভী বলেছেন, এবার হয়তো নানা কারণে পরিস্থিতি একটু কঠিন, তবে জয় নিয়ে শ’ঙ্কা নেই।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে বিএনপি দ্বৈতনীতি নিয়ে চলছে। একদিকে ঘোষণা দিয়েছে রেখেছে, তারা দলীয়ভাবে এই সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু অনেক জায়গায় বিএনপির পরিচিত নেতারা ধানের শীষ প্রতীক ছাড়া স্বতন্ত্রভাবে অন্য প্রতীকে নির্বাচন করছেন এবং জয়লাভও করছেন। যারা জয়লাভ করছেন তাদের দল থেকে বহিষ্কারের কোনো খবর জানা যায়নি। জিতলে দলের কৃতিত্ব, হারলে দলের দায় নেই – বিএনপির এই নীতি দলের মধ্যে এবং দলের বাইরে সমালোচিত হচ্ছে । নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও বিএনপি একটি দ্বিমুখী নীতি নিয়ে আছে। তৈমূর আলম খন্দকার জিতলে বলা হবে আওয়ামী লীগ শেষ। আর হারলে বলা হবে, তিনি তো আমাদের কথা শোনেননি। দলের অবাধ্য হওয়ার খেসারত তাকে দিতে হলো।
১৮ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি হয়ে আছেন আইভী। এবার কি নারায়ণগঞ্জবাসী পরিবর্তনের পক্ষে নাকি যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবেন? তৈমূর আলম খন্দকার একজন শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সন্দেহ নেই। কিন্তু তার পক্ষে ভোটের হাওয়া প্রবলভাবে বইছে, তেমন কোনো খবর এখনো নেই।
অন্যদিকে আইভী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীক নৌকা পেলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের পূর্ণ সমর্থন তার দিকে না থাকার কথা শোনা যাচ্ছে। সংসদ সদস্য শামীম ওসমান এবং তার সমর্থকরা আইভীর পক্ষে সেভাবে নেই। অবশ্য সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, ‘তার (শামীম ওসমান) সমর্থন খুব কি জরুরি এই নির্বাচনে? তিনি একজন সংসদ সদস্য। (নির্বাচনী আচরণবিধির কারণে) ইচ্ছা করলেও তিনি আসতে পারবেন না।’
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগে দুই পরিবারের দ্বন্দ্ব পুরনো। ওসমান পরিবার এবং চুনকা পরিবারের বিরোধ মেটানোর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। ওসমান পরিবারের শামীম ওসমান এবং চুনকা পরিবারের সেলিনা হায়াৎ আইভীর মধ্যে বিরোধও নতুন কিছু নয়। শামীম ওসমান এবং তার লোকজন আইভীর পক্ষে নামবে না-এই আশঙ্কা থেকেই সম্ভবত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ আইভীর পক্ষে থাকার জন্য, তাকে জিতিয়ে আনার জন্য আগেভাগেই সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ না করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। শামীম ওসমান ও সমর্থকদের ওপর এসব হুঁশিয়ারি প্রভাব ফেলবে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহার একটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খোকন সাহা মেয়রপ্রার্থী আইভীর নাম ভাঙিয়ে একজন ঠিকাদারের কাছে টাকা দাবি করায় আইভী নিজেই তার শাস্তি দাবি করেছেন। শুধু নারায়ণগঞ্জে নয়, সারাদেশেই নৌকা ঠেকাতে নৌকার লোকজনই কাজ করছে। আওয়ামী লীগের এটাও এক বড় সমস্যা। দলের শৃঙ্খলা দারুণভাবে ভেঙে পড়েছে।
একেক জায়গার চিত্র একেক রকম। কোথাও দলীয় কোন্দল নৌকাডুবির কারণ হয়, কোথাও আবার হয় না। নারায়ণগঞ্জে এর আগেও কোনো নির্বাচনে শামীম ওসমানের সমর্থন না পাওয়ায় আইভীর জয়লাভে কোনো সমস্যা হয়নি। এবার হবে, তেমন আশ’ঙ্কা প্রবলভাবে আছে বলেও মনে হয় না।
আওয়ামী লীগ পরপর কয়েক ধাপে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার কারণে জনসাধারনের একটি অংশের মধ্যে এই দলটি নিয়ে বিরুপতার সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ শাসক দল হিসেবে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের থেকে অনেকাংশেই ভালো। এটা অনেকে মনে মনে স্বীকার করলেও মুখে অস্বীকার করে। কারণ নৌকা বা অন্য প্রতীক নিয়েও এর আগে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সকলেরই রয়েছে। তবে তারা তুলনা করলে এই বিষয়টি সহজে প্রকাশ করে না। এদিকে নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী আইভীর প্রশ্ন উঠলে দেখা যায় সেখানকার মানুষের মধ্যে আবেগের একটি বিষয় কাজ করে, এমনটা শোনা গিয়েছে। তিনি যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন, তাই তার কিছু বদনাম হতেই পারে। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও নিয়ম বহির্ভূত কাজ করা বর্তমান সময়ে যারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে রয়েছেন তাদের একটি স্বাভাবিক ব্যাধি হয়ে দাড়িয়েছে। ক্ষমতায় গিয়েছেন কিন্তু কোনো দুর্নীতি করেনি বা অনিয়ম করেনি এমন কোন জনপ্রতিনিধি খুঁজে পাওয়া কঠিন। সেলিনা হায়াৎ আইভী গত ১৮ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন, কিন্তু সেই দীর্ঘ সময়ের তুলনায়, তার বিরুদ্ধে তখন বড় ধরনের কোনো অভিযোগ আনতে পারেনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলোর প্রতিনিধিরা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে কে বিজয়ী হবেন এবং ফলাফলে কোনো চমক আসবে কিনা, সেটা এ মুহুর্তে বলা না গেলেও নির্বাচন সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হোক এবং নির্বাচন দিতে ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে কোন রকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি না হয়ে ঘরে ফিরে যাক, এটাই আমাদের সকলের একমাত্র প্রত্যাশা।
লেখনী: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকার।