দীর্ঘ সময় ধরে নানা সংকটের মধ্যে দিয়ে নিজেদের সময় পার করছে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল বিএনপি। এমনকি সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে নির্যাতিত-নিপীড়িত দলটি। তবে চলমান সকল সংকটময় পরিস্তিতি মোকাবিলা করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে দলটি নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এই সংকট মোকাবিলায় নতুন বছরকে ঘিরে ৪ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দলটি। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানালেন বিএনপি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
নতুন বছরে প্রধানত চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে। দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে সুচিকিৎসা, সারা দেশে দলের ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর নামে দায়ের করা লক্ষাধিক মামলা মোকাবিলা, অর্ধশত জেলা কমিটি গঠনসহ দেশব্যাপী সাংগঠনিক পুনর্গঠন এবং জাতীয় নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়। এই চ্যালেঞ্জগুলোকে সামনে রেখেই নতুন বছরের কর্মকৌশল নিয়েছে দলটি। তার ভিতরেও আরও বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। আজ রাতে অনুষ্ঠেয় দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নতুন কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হতে পারে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার্থে বিদেশে পাঠানোর দাবিতে দুই-এক দিনের মধ্যে এই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার্থে বিদেশে পাঠানো এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করাটাই এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ জন্য আমাদের আন্দোলন চলছে। সে আন্দোলনে জনগণ জেগে উঠেছে। আমরা আশাবাদী। আবারও কর্মসূচি দেওয়া হবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই আমরা দেশনেত্রীর মুক্তি ও বিদেশে উন্নত চিকিৎসাসহ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করব ইনশা আল্লাহ।’
নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, সারা দেশে দলের ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন সরকারের দায়ের করা লক্ষাধিক মামলার যে খড়গ ঝুলছে- তা মোকাবিলায় ভুক্তভোগী নেতা-কর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য গঠিত সেলগুলো শিগগিরই সচল করা হচ্ছে। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সিনিয়র আইনজীবীরা এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অন্যদিকে- দেশব্যাপী দলের ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ইতোমধ্যে মাত্র ৩০টিতে নতুন কমিটি গঠন সম্ভব হয়েছে। বাকি ৫১টি মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলায় কমিটি গঠন করতে হবে। এ ছাড়া আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনের দাবি আদায়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে চায় দলটি। এর মাধ্যমে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে চায় বিএনপি। স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন, ‘এ সরকারের সময় প্রায় শেষ। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় থাকলে যা হয় আরকি। এবার জনগণ জেগে উঠেছে। ভোট নিয়ে আর প্রতারণার সুযোগ তাদের দেওয়া হবে না। ইনশা আল্লাহ গণআন্দোলনের মাধ্যমেই মানুষের ভোটাধিকারসহ সব অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসাসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করা হবে। এই নতুন বছরে এই সরকারকে বিদায় করেই নেত্রীকে মুক্ত করব ইনশা আল্লাহ।’
বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা: উন্নত চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর দাবিতে ২২ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩১টি জেলায় সমাবেশ করেছে বিএনপি। আজ কক্সবাজার জেলা বিএনপির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হবে। দলীয় প্রধানের বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টিকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে দলটি। তাঁর বিদেশে চিকিৎসার জন্য বাকি জেলাগুলোতেও সমাবেশ করবে তারা। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বাকি জেলাগুলোতে সমাবেশ শেষে পরবর্তীতে ফের উপজেলা, পৌরসভা পর্যায়ে বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচিরও প্রস্তাব করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির পর মহানগরী পর্যায়ে সমাবেশ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, অবস্থান, অনশন ও মহাসমাবেশসহ বিভিন্ন রকমের টানা কর্মসূচির কথা ভাবছে দলটি। এ প্রসঙ্গে বিএনপি স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য নজরুল ইসলাম খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আন্দোলনের ধারা পাল্টে নতুন ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে হবে এবার। প্রয়োজনে কাফনের কাপড় মাথায় নিয়ে আমাদের সবাইকে রাজপথে নামতে হবে। নেত্রীকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আমরা কেউ ঘরে ফিরে যাব না।’
মোকাবিলা করতে হবে মামলা: বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় অথচ মামলা নেই- এমন নেতা-কর্মী দেশে দেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া দায়। দলটির শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সক্রিয় সব নেতা-কর্মীর নামেই বিভিন্ন অভিযোগে মামলা রয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই জেল খেটেছেন একাধিকবার। অধিকাংশ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে আদালতে। চলছে বিচারকাজ। উচ্চ আদালতের আদেশে আটকে আছে অনেক মামলার বিচারকাজ। এসব মামলায় নিম্ন আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন হাজার হাজার নেতা-কর্মী। হাজিরা না দেওয়ায় জামিন বাতিল হয়েছে অনেকের। সব মামলাতেই আসামি রয়েছেন শত শত। মামলার কারণে শুধু বিএনপিই নয়, জোটের মিত্ররাও এখন দিশাহারা। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত বিএনপির ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর নামে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো মামলা রয়েছে। বেশির ভাগ নেতার নামেই ১০০-এর উপরে মামলা আছে। এমন বাস্তবতায় জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলতে মামলা মোকাবিলায় নানামুখী কৌশল খুঁজছে বিএনপি। এ নিয়ে দল ও দলের বাইরের সিনিয়র আইনজীবীদের নিয়ে একটি সেল গঠন করা হয়েছে অনেক আগেই। মামলায় জর্জরিত হয়ে প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কোণঠাসা ও অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন। জানা গেছে, সাংগঠনিক কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সৎ, যোগ্য ও সাহসী নেতাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
অর্ধশতাধিক জেলা কমিটি: বেশিরভাগ জেলা কমিটিই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। দুই বছর মেয়াদি এসব কমিটির মেয়াদ শেষ না হওয়ায় জাতীয় কাউন্সিলের প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু একাধিক কারণে তা শেষ করা সম্ভব হয়নি। মাত্র ৩০টি জেলা কমিটি গঠন সম্ভব হয়েছে। বাকি রয়েছে আরও ৫১টি সাংগঠনিক জেলা। চলতি বছর এসব কমিটি গঠনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বিএনপিকে।
বর্তমান সময়ে এই বিএনপি দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শারীরিক ভাবে গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে বিএনপি দল। এমনকি এই লক্ষ্যে নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছে দলটি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও অনুমতি মেলেনি এই বিষয়ে। এমনকি সরকার জানিয়েছে অন্যান্য সকল সাজা প্রাপ্ত আসামীদের থেকে তিনি বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।