সরকারের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১১ মাসে সৌদি আরবে গেছেন ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০২ জন শ্রমিক। এবং মাইগ্রেশন রিসার্চ ফার্ম রামরুর মতে, প্রতি মাসে সৌদি আরবে যাওয়া সমস্ত শ্রমিকদের ১৪ শতাংশ দেশে ফিরে আসে।
আর ৪৯ শতাংশ শ্রমিক এক বছরের মধ্যে ফিরে এসেছে। তবে, বিদেশে কর্মী পাঠানোর সাথে জড়িত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলির একটি অ্যাসোসিয়েশন বায়রা বলছে, দেশে ফেরত আসাদের সংখ্যা খুবই কম, যদিও আগে এমনটা হতো।
সম্প্রতি সৌদি শ্রমবাজার কিছুটা সংকটে পড়েছে। দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তিকে সম্মান করা হয় না। বাংলাদেশি শ্রমিকরা কাজ না পাওয়া থেকে শুরু করে নানা ভোগান্তিতে ভুগছেন। ফলে অনেক শ্রমিককে দেশে ফিরতে হচ্ছে।
দেশের জনপ্রিয় দৈনিক কালের কণ্ঠের সাংবাদিক তৌফিক হাসানের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এতে শুধু প্রবাসী শ্রমিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, প্রত্যাবাসন আয়েও প্রভাব পড়ে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, দক্ষ কর্মী না পাঠানোর কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। অভিবাসন কর্মকর্তাদের মতে, এর জন্য দায়ী দুই দেশের রিক্রুটিং এজেন্সি। সরকারের উচিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান করা।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, হোটেল-রেস্তোরাঁর শ্রমিক, সেলুন শ্রমিক, গৃহকর্মী, কোম্পানির চালক, গৃহকর্মী ও নির্মাণ শ্রমিকের চাকরি নিয়ে বাংলাদেশি শ্রমিকরা দেশে যাচ্ছেন।
কিন্তু দেখা যায় সংশ্লিষ্ট খাতে ওই শ্রমিকরা কাজ পাচ্ছেন না। ভিসার দালালরা প্রকৃত নিয়োগকর্তাদের সাথে অলিখিত চুক্তি করে ভিসা কেনার জন্য এবং দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে। ফলে ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।
সৌদি আরবের নতুন আইন অনুযায়ী, দেশটির কর্তৃপক্ষ নতুন অভিবাসীদের শুধুমাত্র তিন মাসের রেসিডেন্ট পারমিট (ইকামা) দিচ্ছে।
এই সময়ের মধ্যে যদি কোনো প্রবাসী তার ভিসা অন্য কোম্পানির নামে ট্রান্সফার করতে না পারেন, তাহলে তাকে পরবর্তীতে রেসিডেন্ট পারমিট নবায়ন করতে একটি বড় ফি দিতে হবে। এতে শ্রমিকদের অবৈধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এরপর তাকে ফিরে আসতে বাধ্য করা হয়।
কুমিল্লার বাসিন্দা মোহাম্মদ ফরহাদ গত ফেব্রুয়ারিতে একটি প্লাস্টিক কোম্পানিতে কাজ করতে সৌদি আরবে যান। এ জন্য তিনি সুদসহ সাড়ে চার লাখ টাকা ঋণ নেন। কিন্তু সেই প্লাস্টিক কোম্পানিতে চাকরি পাননি ফরহাদ।
ফরহাদ বলেন, “আমাকে বলা হয়েছিল যে আমি একটি প্লাস্টিক কোম্পানিতে কাজ করব। ১ হাজার ৫০০ রিয়াল দেব। কিন্তু সৌদি আরব নেওয়ার পর আমাকে মরুভূমিতে ছেড়ে দিয়েছে। চার-পাঁচশ মাইলের মধ্যে কোনো বাড়ি নেই। তারপরও আমি পাঁচ বছর থেকেছি। মাস। তারা কিছুই দেয়নি। এরই মধ্যে আমার ইকামা শেষ হয়ে গেছে। আমি বাসায় ফোন করে টাকা চাই।
ফরহাদ বলেন, “মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘বাবা, আমি তোমাকে ধার করে বিদেশে পাঠিয়েছি।’ এখন সুদ দিচ্ছি।আল্লাহ জানে আর কত দিন দিতে হবে।এখন টাকা কোথায় পাব।’ এরপর আমি সেখান থেকে পালিয়ে আসি। পরে আমাকে গ্রেফতার করে ১৪ দিন জেল খাটতে হয় এবং দুই মাস আগে দেশে ফিরে আসি।”
মাইগ্রেশন রিসার্চ ফার্ম রামরু এর দুই সপ্তাহ আগে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি মাসে সৌদি আরবে যাওয়া শ্রমিকদের ১৪ শতাংশ সেই মাসেই ফিরে আসে। এছাড়াও, সৌদি আরবে যাওয়া শ্রমিকদের 13 শতাংশ প্রথম তিন মাসের মধ্যে, ২৪ শতাংশ ছয় মাসের মধ্যে এবং ৪৯ শতাংশ এক বছরের মধ্যে ফিরে এসেছে।
রামরু বলেন, ফেরার কারণগুলো হলো চুক্তি অনুযায়ী কাজ না পাওয়া, একেবারেই কাজ না পাওয়া, ইকামা বাতিল, ঠিকমতো বেতন না পাওয়া, মালিকের নির্যাতন, গ্রেপ্তার, কম বেতন ও শারীরিক অসুস্থতা।
রামরুর গবেষণার অনুরূপ সাতক্ষীরার বাসিন্দা সালাহউদ্দিনের অভিজ্ঞতা। ২০২২ সালের জুলাই মাসে সালুদ্দিন সৌদি আরবে যান। তিনি বলেন, “যে মালিক আমাকে ভিসা দিয়েছিলেন তিনি আমাকে কোনো কাজ দেননি। আমি প্রায় তিন মাস কোনো কাজ করিনি, ঠিকমতো খাবারও পাইনি। পরে, আমি কাজ পাওয়ার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি। কারণ আমি ভাষা জানতাম। এতে আমার খরচ হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। আমি সেখানে প্রতি মাসে ৩৫ ,০০০ থেকে ৪০ ,০০০ টাকা বেতন পেতাম, যা আমার খরচও ছিল না। আমি এই জন্য এসেছি।’
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান শাখার কর্মকর্তাদের মতে, সৌদি শ্রমবাজারে দুই ধরনের সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, চাকরির চেয়ে বেশি কর্মী আছে। দ্বিতীয়ত, যেসব এজেন্ট শ্রমিক নেয় তারা ঠিকমতো কাজ করে না। বাংলাদেশি এজেন্টরা সে দেশের কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে, তারা এত কর্মী দেবে, এত টাকা লভ্যাংশ হিসেবে দেবে। এরপর তারা শ্রমিকদের নিয়ে চলে যায়। আবার অনেককে আটক করে নির্যাতন করা হয়।
সৌদি আরবে কর্মী পাঠায় এমন একটি রিক্রুটিং এজেন্সি আদিব এয়ার ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের মালিক কে এম মোবারক উল্লাহ শিমুল বলেন, “আমাদের বেশ কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের দিকে না তাকিয়েই শুধু কর্মী পাঠাচ্ছে। এ কারণেই সেখানে একটি এই শ্রমবাজারে সমস্যা।আর বাংলাদেশ ভিসা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ নয়।ভিসা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ সৌদি সরকার।তাদের এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।