সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ র্যাবের ৮ কর্মকর্তা কে নিষেধাজ্ঞার পর থেকে শুরু হয়েছে তোলপাড়। আগেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মানুষকে গুম করার মতো অভিযোগ রয়েছে। যে অভিযোগগুলোর বেশিরভাগেরই উত্তর এখনো বাংলাদেশে দিতে পারেনি। সম্প্রতি এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনার মুখে বাংলাদেশ। সম্প্রতি এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ এমনটাই জানা গেছে মন্ত্রণালয় থেকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মানুষ জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুমের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে জাতিসংঘের। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কাছে জবাব চাইছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজ-অ্যাপিয়ারেন্স।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক নিখোঁজ বা গুমের বিষয়ে জাতিসংঘকে সন্তুষ্টজনক জবাব দিতে চায় বাংলাদেশ। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা, ধারণা, ব্যবস্থা ও প্রতিবেদন প্রতিরোধে উদ্যোগ নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এ জন্য গদবাধা জবাবের বাইরে এসে কেস টু কেস ডিটেইলিং বা গ্রাউন্ড রিয়েলিটি এক্সপ্লেইনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
সূত্র জানায়, এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মানুষ গুমের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে জাতিসংঘের। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কাছে জবাব চাইছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজ-অ্যাপিয়ারেন্স (ডব্লিউজিইআইডি)।
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে গুম নিয়ে ডব্লিউজিইআইডিকে সন্তুষ্ট করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার বাংলাদেশের কাছে ডব্লিউজিইআইডির প্রশ্নের বিষয়ে তাদের অবগত করা নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়। এতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় ছাড়াও পুলিশ, র্যাবসহ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুম নিয়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশের কাছে যা জানতে চেয়েছে, সে বিষয়ে তাদের অবগত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা।’
গত এক দশকে বাংলাদেশের কাছে ৮৩ জনের গুম হওয়া নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছে ডব্লিউজিইআইডি। এ নিয়ে আগে বৈঠক করে জাতিসংঘকে উত্তর দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে কোনোবারই জাতিসংঘ বাংলাদেশের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই বিষয়টি এবার গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে বাংলাদেশ।
কারণ সামনে ডব্লিউজিইআইডির বৈঠক হবে। এরপরই রয়েছে ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ। তার আগেই জাতিসংঘকে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সন্তুষ্ট করতে চায় ঢাকা।
বৈঠক সূত্র জানায়, জাতিসংঘ এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৮৩ জনের একটি তালিকা দিয়েছে। এর মধ্যে সাতজনের বিষয়ে তথ্য দিতে পেরেছে বাংলাদেশ। বাকিদের বিষয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তথ্য দিতে হবে। তাই সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে তাদের কাছ থেকে যথাযথ উত্তর চাওয়া হয়েছে, যাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা জাতিসংঘকে জানাতে পারে।
সূত্রটি বলেছে, বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘের এ ধরনের নেতিবাচক প্রতিবেদন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ফলে বাংলাদেশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিষয়ে বিরূপ মনোভাব জন্ম নিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই আগে থেকেই বিষয়টিতে প্রতিকারমূলক প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ও ক্ষতি কীভাবে ঠেকানো যায়, তা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, জাতিসংঘকে বাংলাদেশ যে উত্তর দিয়েছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তবে কেন সন্তুষ্ট হয়নি, তার বিস্তারিতও বলেনি। জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তাই সভায় উপস্থিত সংশ্লিষ্টদের গতানুগতিক ব্যাখ্যা থেকে বের হয়ে সঠিক ও ‘গ্রাউন্ড রিয়ালিটি’ দিতে বলা হয়েছে।
গত বছরের বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জন ব্যক্তির অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশের কাছে চিঠি দিয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল।
ডব্লিউজিইআইডি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। সেই চিঠির সূত্র ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি পুলিশের বিশেষ শাখা এসবিতে একটি চিঠি পাঠায়।
এ নিয়ে গত বছর আগস্টে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘দুনিয়ার সব দেশেই কম-বেশি গুম হয়। তবে তারা (জাতিসংঘ) ভারতকে কিছু বলে না, পাকিস্তানকে কিছু বলে না। আমরা তাদের বেশি পাত্তা দিই। তাই তারা আমাদের অনবরত হ্যামার করে।
‘যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালে ১ হাজার ৩৪ জন গুম হয়েছে। কই তারা তো এটা নিয়ে কিছুই বলে না। তবে আমাদের কাছে তারা যেটা জানতে চেয়েছে, আমরা তার জবাব দেব।’
২০১৯ সালে ডব্লিউজিইআইডির প্রতিবেদনে গুম প্রশ্নে বাংলাদেশ নিয়ে বেশ নেতিবাচক তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, জোরপূর্বক নিখোঁজ হওয়া থেকে সব নাগরিককে সুরক্ষা দেয়ার যে ঘোষণা, তা লঙ্ঘন এবং এই ঘোষণা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গুম অব্যাহত আছে বলে উল্লেখ করা হয়। সেই সঙ্গে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ৫০৭ জন জোরপূর্বক নিখোঁজ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬২ জন নিহত হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে ২৮৬ জন ফিরে এলেও ১৫৯ জনের কোনো খোঁজ এখনও মেলেনি।
এর আগে একই ধরনের প্রতিবেদন ২০১৭ সালে প্রকাশ করেছিল ডব্লিউজিইআইডি।
এবার ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউর পর ডব্লিউজিইআইডি আবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। আগের দুই প্রতিবেদনের মতো এমন অভিযোগের উল্লেখ করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নামে যাতে কোনো নেতিবাচক বিষয় যাতে উঠে না আসে, সে বিষয়ে ঢাকা এবার বিশেষভাবে সচেতন।
যদিও বাংলাদেশের ব্যাপারে তথ্য দিতে বাংলাদেশ প্রস্তুত হচ্ছে তবে ক্ষোভ এখানেই থেকে যায় যে বাংলাদেশের তুলনায় বাইরের দেশগুলোতে আরো বেশি গুমের খবর পাওয়া যায় যদিও তার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাধ্যমগুলোর কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশ থেকে কি প্রতিবেদন জাতিসংঘকে দেওয়া হয় আর প্রতিবেদনে সবার কথা লেখা থাকে কিনা। সাথে এটাও দেখার বিষয় কবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে, আর সেই প্রত্যাহারের জন্য বাংলাদেশকে কি কি মাশুল দিতে হয়।