পিকে হালদার নামটি বাংলাদেশের একটি বহুল আলোচিত এবং সমালোচিত একটি। ৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করে পালিয়েছেন তিনি বিদেশে। আর গেল কয়েকদিন আগে তার দুই নারী সহকারী হয়েছেন গ্রেফতার।পিকে হালদারের ঘনিষ্ঠজন পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক খবির উদ্দিনের দুই মেয়ে শারমিন আহমেদ ও তানিয়া আহমেদ ‘কিছু হবে না’ আশ্বাস দিয়ে দেশে এসেছেন। দলটি নিজেদেরকে সরকারের ‘খুব ঘনিষ্ঠ’ বলেও পরিচয় দেয়। প্রভাবশালী মহল এই দুই নারীকে বুঝিয়ে বলে, “তাদের কানাডিয়ান পাসপোর্ট থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করতে পারে না।” আশ্বাসও দেওয়া হয়, ‘প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ম্যানেজ করা হবে, তারাও খেয়াল করবে না’।
পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নীরবে কানাডায় ফিরতে পারবেন এই আশা নিয়ে গত ২৮ জুলাই ঢাকায় আসেন দুই বোন শারমিন আহমেদ ও তানিয়া আহমেদ। প্রায় এক মাস অতিবাহিত হলেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আদালত নিজেই। অবশেষে একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে কানাডায় ফেরার সময় দুই বোনকে আটক করে র্যাব।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুই নারী জানান, তাদের বলা হয়েছে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করবে না। তাদের ভাই ওমর পুরো বিষয়টি নিয়ে কথিত প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। ওমরের বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন। এই দুই নারী কানাডা থেকে বাংলাদেশে এসে এক মাস ধরে বিয়েসহ বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
চলতি বছরের এপ্রিলে শারমিন আহমেদ ও তানিয়া আহমেদকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন আদালত। তবে প্রভাবশালী মহলের আশ্বাসে ২৮ জুলাই দেশে আসেন তারা। পারিবারিক বিভিন্ন কাজ সেরে গত ২৪ আগস্ট ভোরে তারা কানাডা যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হন। এ সময় একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব তাদের গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তারের পর ওই দুই নারীকে হাইকোর্টে হাজির করা হয়। দেশে থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে টাকা আত্মসাৎকারী এই দুই নারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি বলে আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
হাইকোর্টের বিচারপতি আহমেদ খুরশীদ আলম সরকার মন্তব্য করেছেন, র্যাব বাহিনীর হাতে দুই নারীকে সাদা পোশাকে গ্রেপ্তার করায় সাধারণ মানুষ তাদের টাকা ফেরত পেতে সহায়তা করবে। আদালতের নির্দেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে অভিযান পরিচালনা করে র্যাব সাধারণ জনগণ ও রাষ্ট্রের আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এমনকি র্যাবকেও আদালতের আদেশে এই কাজটি অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেন তিনি।
দুই বোনকে আটকের পর তাদের পাসপোর্ট হেফাজতে নেয় র্যাব। পরিবারের বাকি ৯ সদস্যের পাসপোর্ট জমা না দেওয়া পর্যন্ত বোন শারমিন আহমেদ ও তানিয়া আহমেদের পাসপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের পুলিশি হেফাজতে রাখতে বলা হয়েছে।
অর্থ আত্মসাতের মামলায় গ্রেফতারকৃত পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানির পরিচালক খবির উদ্দিনের দুই মেয়ে শারমিন আহমেদ ও তানিয়া আহমেদকে প্রায় ১৯৭ কোটি টাকার ঋণের ৫ শতাংশ (প্রায় ১০ কোটি টাকা) পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
র্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শারমিন ও তানিয়া দুই দশক ধরে কানাডায় বসবাস করছেন। গত ২৮ জুলাই পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তারা দেশে আসেন। গত ২৪ আগস্ট তারা দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছিলেন। এর আগে সকালে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে দুজনকে আটক করা হয়। দুই বোন কানাডার নাগরিকত্ব অর্জনের পাশাপাশি সেখানে বাড়িঘরসহ বিশাল সম্পদ গড়ে তোলেন। যা তারা বাংলাদেশ থেকে আত্মসাৎ করেছে।
তাদের বাবা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানির পরিচালক খবির উদ্দিন পিকে হালদারের অন্যতম সহযোগী। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি কোম্পানিটির পরিচালক ছিলেন। এ সময় তিনি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ঋণ আত্মসাৎ করেন। পরবর্তীতে ২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাকে এই পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।
চলতি বছরের ৭ মার্চ কোম্পানির ঋণখেলাপিদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে তারা হাজির না হওয়ায় আদালত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ১৯ এপ্রিল গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।
গ্রেফতারকৃত দুজন তাদের বাবা খবির উদ্দিনের মাধ্যমে ঋণ নিয়েছিল। শারমিন ৩১ কোটি ও তানিয়া ৩৩ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিকে ২৪ নভেম্বর ১৯৯৭ তারিখে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন দেয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯ সালে কোম্পানিটির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। সে সময় আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। পিকে হালদারসহ কোম্পানির বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে।
প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৬,০০০ ব্যক্তি বা শ্রেণির আমানতকারী রয়েছে এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীর প্রায় ১,৮০০ কোটি টাকা আটকে আছে। এ অর্থের একটি বড় অংশ কোম্পানির পরিচালকরা বিভিন্ন নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।
প্রসঙ্গত, এ দিকে এই ঘটনার মুল হোতা পিকে হালদারকে এখনো গ্রেফতার করে বাংলাদেশে আনতে পারেনি দেশের সরকার। এখনো তিনি বহাল তবিয়তে বিদেশে রয়েছেন। তবে সরকার থেকে জানানো হয়েছে খুব শিঘ্রই তাকে গ্রেফতার করা হবে।