Thursday , November 14 2024
Breaking News
Home / opinion / দেশের ব্যাংকগুলোতে কেন টাকা নেই, এর কারণ দুটি : জিয়া হাসান

দেশের ব্যাংকগুলোতে কেন টাকা নেই, এর কারণ দুটি : জিয়া হাসান

বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের সব থেকে অস্থিরতম খাতের নাম ব্যাংকিং খাত। দেশের ব্যাংকগুলোর অবস্থা এখন বেশ খারাপ। আর এই কারনে এ নিয়ে সবখানে চলছে বেশ উৎকণ্ঠা। এবার এ নিয়ে একটি বিশ্লেষণাত্মক লেখনী লিখেছেন লেখক জিয়া হাসান। পাঠকদের উদ্দেশ্যে তার সেই লেখনী তুলে ধরা হলো হুবহু:-

কেন ব্যাংকে টাকা নাই ???১

আমি এখন যে আলোচনাটা করবো, তা খুব গোছানো নয়, আমি আমার মনের কিছু বিচ্ছিন্ন ভাবনা, কিছু অর্থনীতিবিদ বন্ধুদের সাথে আলোচনা এক জায়গায় আনার চেষ্টা করছি।

সবার প্রথমে আমরা লিকুইডিটি বা তারল্য এই দুইটা শব্দকে দূরে ফেলে দেবো। আমার হিসেবে এই দুইটা মিসনমার। এই দুইটার আরো সহজ প্রতিশব্দ আছে, তা হচ্ছে – টাকা, বা আরো গুছিয়ে বললে খরচ করার মত টাকা।

প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাংকের কাছে খরচ করার মত টাকা নাই কেন ?

এই বিষয়ে অনেক গুলো কম্পিটিইং থিয়োরি আছে। প্রবলেম হচ্ছে, কোন থিয়োরির প্রভাব কত কোন টাই প্রপারলি ডাটা ব্যাকড না। কিন্তু, এইটা কোন একাডমিক জার্নাল না, ফেসবুক পেজ- আমরা হাইপোথেসিস গুলো আলোচনা করতে পারি।

কিন্তু, সেইটা করার আগে, একটা সংজ্ঞা ঠিক করা দরকার, খরচ করার মত টাকা বলতে আমরা কি বুঝি। অনেকেই মনে করেন, লিকুইডিটি মানে ক্যাশ টাকা, প্রিন্ট করা টাকা ইত্যাদি।

নো। ব্যাংকের তারল্য বা খরচ করার মত টাকা বলতে আমরা, চারটা আইটেম বুঝি, যা কারেন্ট এসেটসের অধীনে থাকে ।

১। ক্যাশ। যেইটা কাস্টমাররা তুলে নেয়, জমা দেয়।

২। বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা সংবিধিবদ্ধ অর্থ। এই টাকাটা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রাখতে হয় যেন, হঠাত করে যদি কাস্টমারের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, সেইটা যেন বিবির কাছ থেকে ব্যাংক পেতে পারে।

৩। ব্যাংক গুলো শর্ট নোটিসে যে বিনিয়োগ করে, যেমন কল মানি।

৪। ব্যাংক যদি অন্য কোথাও শর্ট টাইম বিনিয়োগ করে, যে টাকা চাহিদা মাত্র পেতে পারে।

ফলে, এইটা স্পস্ট আমরা যখন লিকুইডিটির ক্রাঞ্ছের কথা বলি, তখন কারেন্ট এসেটসের অধীনে এই চারটা আইটিমের কথা বলি। শুধু মাত্র ক্যাশ টাকা বা পেপার মানির কথা বলি না।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সিস্টেমে খরচ করার মত এই টাকা টা হ্রাস পেয়েছে।

এতো পরিমান হ্রাস পেয়েছে যে, ৯% সর্বোচ্চ ইন্টেরেস্ট রেটের সময়ে ব্যাংক গুলো একে অপরের কাছ থেকে ১০% হারে ঋণ করতেছে।কেন এই অবস্থা তৈরি হইলো ? অবস্থা টা কি ? এই অবস্থা তৈরি হইলে প্রবলেম কি ? কোন দিকে যাচ্ছে ? এইটা নিয়ে আমি সিরিজ অফ আলোচনা করবো।

আমরা প্রথমে আলচনা করবো অবস্থাটা কি এবং এই অবস্থা তৈরি হইলে প্রব্লেম কি ।

ব্যাংকিং ক্রাইসিস মুলত দুই ধরনের।

১। লিকুইডিটি ক্রাইসিস।

২। ইন্সল্ভেন্সি।

লিকুইডিটি ক্রাইসিস হইলো আপনার এসেট আছে, মানে সম্পদ আছে। কিন্তু, আপনার শর্ট টার্ম দায় এতো বেশী, সেইটা পরিশোধ করার জন্যে টাকা আপনার নাই। কথার কথা, আপনি ঋণ দিয়েছেন, ১০ কোটি টাকার। সেই টাকা আপনি ফেরত পাবেন, বছরে ১ কোটি টাকা করে। কিন্তু, যে কাস্টমারদের কাছে থেকে আপনি টাকা নিয়েছেন, তারা এখন ৫ কোটি টাকা চাইছে। আপনার কাছে, ৪ কোটি টাকা শর্ট। এইটা হইলো লিকুইডিটি ক্রাইসিস।

ব্যাংক রান হয় মুলত লিকুইডিটি ক্রাইসিসের কারনে। অর্থাৎ কাস্টমাররা যদি সবাই এক সাথে ব্যাংকের কাছে টাকা চায় তবে লিকুইডিটি ক্রাইসিস হইতে পারে।

কিন্তু, বাংলাদেশের সিচুয়েশানটা ব্যাংক রান নয়। ইসলামী ব্যাংক গুলো থেকে টাকা তুলে নেওয়ার কথা শুনলেও, খুব একটা বড় কোন ব্যাংক রান হইতেছেনা, স্বাভাবিকের তুলনায় কিছু বেশী টাকা তোলা হচ্ছে, কিন্তু, কিছু ব্যাংক সেই টাকায় ফেরত দিতে হিমসিম খাচ্ছে। ঋণ করে, বাংলাদশ ব্যাংক থেকে ধার করে সেই টাকা ফেরত দিচ্ছে, যেইটা স্পষ্টতই লিকুইডিটি ক্রাইসিস।

অন্য দিকে, ব্যাংকের আরেকটা ক্রাইসিস হয় যাকে বলা হয় ইন্সল্ভেন্সি। ব্যাংকের এসেট হইতেছে তার দেওয়া ঋণ । আর লায়াবিলিটি হইলো, তার কাস্টমারদের টাকা এবং ব্যাংকের শেয়ার হোল্ডাররা দেওয়া মুল্ধন ।

এখন ধরে নিন কোন ব্যাংকের কাস্টমার দের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ এবং শেয়ার হোল্ডারদের ইকুইটি অর্থাৎ লায়াবিলিটির পরিমান ১০ কোটি টাকা। ঋণ দিয়েছে, ১০ কোটি টাকা টাকা। এখন সেই ১০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৫ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি হয়ে ফেরত আসে নাই। অর্থাৎ, এসেট নাই হয়ে গ্যাছে। এই অবস্থায় ব্যাসেল নিয়ম অনুসারে, উদ্যোক্তাদের আরো ৫ কোটি টাকা জমা দিতে হবে। কারন যদি না দেয় তাহলে, ডেপোজিটর দের অর্থ মাইর যাবে ।

কিন্তু, এই টাকাটা যখন উদ্যোক্তা দিতে পারবে না, তখন ব্যাংক ইন্সল্ভেন্ট বা দেউলিয়া হবে।

আজকের আলোচনা আমরা, এই দ্বিতীয় দিকটা নয়, বরং প্রথম দিকটা বা লিকুইডিটি ক্রাইসিস ডিল করতেছি । ব্যাংকের যে এসেট আছে তার মধ্যে আছে, শর্ট টার্ম এসেটস বা কারেন্ট এসেটস, অন্য দিকে আছে লং টার্ম এসেটস।

কেন শর্ট টার্ম এসেটস এতো পরিমান হ্রাস পেয়েছে যে, ব্যাংক তার শর্ট টার্ম লায়াবিলিটি যে কাস্টমারদের ডিমান্ড করা টাকা বা কমিট করা ঋণের যে অর্থ তার দেওয়ার কথা সেইটা দিতে পারতেছেনা ?

শর্ট টার্ম এসেট হচ্ছে, যে চারটা জিনিষ আমি বললাম। ক্যাশ, বাংলাদেশ ব্যাংকে বিধিবদ্ধ সংরক্ষন, সাময়িক বিনিয়োগ এবং শর্ট টার্মে ফেরত পাওয়ার মত যে কোন অর্থ। কিন্তু, ব্যাংকের লং টার্ম এসেটস হচ্ছে, দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ।

ব্যাংকের লিকুইডিটি ক্রাইসিসের একটা প্রধান কারন হইতে পারে, এই দীর্ঘ মেয়াদি ও স্বল্প মেয়াদি এসেটের মিসম্যাচ। অর্থাৎ, ব্যাংকের দীর্ঘ মেয়াদি এসেটস বেড়ে গিয়ে যদি ব্যাংকের শর্ট টার্ম এসেটস এতো কমে যায় যে, ব্যাংক তার শর্ট টার্ম লায়াবিলিটি বা কাস্টমারদের চাওয়া টাকা ফেরত দিতে না পারে তখন লিকুইডিটি ক্রাইসিস হবে। এইটা কিভাবে হইতে পারে , তা আমরা কমন সেন্স থেকে বুঝতে পারি।

যদি আপনার খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায়, কিন্ত, সরকার আপনাকে বাধ্য করে ঋণ খেলাপি ঘোষণা না করতে তখন আপনার স্পস্টতই লিকুইডিটি ক্রাইসিস হবে।

খেলাপি ঋণের কারনে যেইটা হওয়ার কথা ছিল ইন্সল্ভেন্সিস, খেলাপির ক্লাসিফিকেশান করতে না দিয়ে, উদ্যোক্তাদের সেই মুল্ধন জোগান দেওয়ার সংকট থেকে রক্ষা করে সরকার সেইটা লিকুইডিটি ক্রাইসিসে রুপান্তর করেছে। বাংলাদেশের লিকুইডিটি ক্রাইসিসের এইটা বড় কারন।

কারন বিগত বছর গুলোতে সরকার তার খেয়াল খুশী মত আইন করেছে যে, অর্থ ফেরত না দিলেও ঋণ খেলাপি ঘোষণা করা যাবেনা। সরকার বিভিন্ন ভাবে খেলাপি ঋণের ক্লাসিফিকেশান পরিবর্তন করার মাধ্যমে মোট খেলাপি ঋণ লুকানোর চেষ্টা করেছে ।আবার সরকার নিজের ইচ্ছে মত বলে দিচ্ছে, ঋণ মাফ, সুদ মাফ করেছে। লিকুইডিটি ক্রাইসিসে এইটার স্পষ্ট ভুমিকা আছে।

ব্যাংকের কারেন্ট এসেটসে হ্রাস পাওয়াতে ৯-৬ ঋণের বড় ভুমিকা রয়েছে। ব্যাংক গুলোর আয়ের মুল উৎস হওয়ার কথা, ঋণ ও ডেপোজিটের মাঝে যে গ্যাপ -ব্যাংকের পরিভাষায় যাকে স্প্রেড বলে। এখন, অনেক ধরনের ঋণ আছে যে ঋণের খরচ ৯-৬=৩ এর থেকে বেশী। আমাকে ব্যাংকের কর্ম কর্তারা বলেছেন এসএমই ঋণের খরচ ৬% থেকে ৭% ও হতে পারে।

ফলে, যেইটা হচ্ছে ব্যাংক গুলো স্প্রেড থেকে প্রফিট না করে, বিভিন্ন ভাবে চার্জ বৃদ্ধি করে, প্রফিটটা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেইটা হয় নাই। ফলে দেখবেন, ২০২২ এ ব্যাংক গুলো ছিল ক্যাপিটাল মারকেটের ওরস্ট পারফরমিং শেয়ার।

বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যাংকের বলতে গেলে কোন মা বাপ নাই।ব্যাংক গুলোর শেয়ার হোল্ড করে পাবলিক, আরে ডিরেক্টরা জাস্ট বোর্ড দখল করে লুটে নিচ্ছে । আর অন্য দিকে সরকার হচ্ছে ব্যাংক গুলোর বাপ, (সৎ বাপ)। সরকার আইন করে দিয়েছেন যেন ব্যাংক গুলো খেলাপি ঋণ ঘোষণা না করতে পারে, সরকার বিভিন্ন ধরনের সুদ মাফ করে দিয়েছে যার এই বাপ মা ছাড়া ব্যাংক গুলোর অপারেটিং প্রফিট হওয়ার সুযোগ নাই।এইটার একটা কন্সিকুয়েন্স আছে। সেই কন্সিকিয়েন্স হচ্ছে, লিকুইডিটি ক্রাইসিস।

এতোক্ষণ যা বললাম তা টাকা না থাকার মত সংকটের মত জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয়ের একটা দিক মাত্র।

পত্রিকা ওয়ালারা বা মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা আপনাকে বলতেছেন যে, এই সংকট শুধু মাত্র বাংলাদেশ ব্যাংকের ডলার কিনে নেওয়ার কারনে ? নট রিয়েলি। অনেক দিক আছে, ভ্যালোসিটি অফ মানি, জিডিপির প্রবৃদ্ধির ডাটা লুকানো, এসেট এর ফিনান্সিয়াল এসেটের রিস্ক ও রিওয়ারডের সম্পর্ক নস্ট করে দেওয়া সহ অসংখ্য বিষয় আছে।

আমি এই সিরিজে, আমার বিচ্ছিন্ন ভাবনা গুলো দিয়ে এই জটিল ও বহুমাত্রিক বিষয় গুলো তুলে আনার চেষ্টা করবো। আশা করি সাথে থাকবেন।

প্রসঙ্গত, গেলো বছরের শেষ এর দিক থেকে মূলত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের পতন শুরু হয়। আর এর মধ্যে সব থেকে বেশি আলোচনার মধ্যে ছিল ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। তবে সব থেকে উত্তরণের আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে দেশের ব্যাংকগুলো।

About Rasel Khalifa

Check Also

আগামীকাল ক্যান্টনম্যান্টে হামলার পরিকল্পনা করেছে আঃলীগ, মিটিংয়ের ভিডিও আসছে: ইলিয়াস হোসেন

ড. বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল শীঘ্রই মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে খুব …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *