দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ভুল পথে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের এই মতামত দিতে প্রভাবিত করছে। কারণ একই সঙ্গে ৮৪ শতাংশ মানুষ বলেছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তাদের জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই জরিপে বাংলাদেশের সঠিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। তারা মনে করেন, সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় অর্থনীতির অবনতি হচ্ছে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বলেন, যারা বলেন অর্থনীতি ভালো না, তারা অর্থনীতি বোঝেন না।
এশিয়া ফাউন্ডেশন ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। তাদের জরিপের শিরোনাম: ‘দ্য স্টেট অব বাংলাদেশ’স পলিটিক্যাল, গভর্ন্যান্স, ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোসাইটি: অ্যাকর্ডিং টু ইটস সিটিজেনস’।
তারা ৬৪ জেলার মোট ১০ হাজার ২৪০ জন নাগরিকের মতামত নেন। প্রতিটি জেলা থেকে সমান সংখ্যক নারী-পুরুষ এই জরিপে অংশ নেয়। তাদের মধ্যে, ৬৪ শতাংশ গ্রাম থেকে এবং ৩৬ শতাংশ শহর থেকে। গবেষণাটি নভেম্বর ২০২২ থেকে জানুয়ারী ২০২৩ সময়কালে পরিচালিত হয়েছিল।
উত্তরদাতাদের রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধি সম্পর্কে নাগরিকদের উপলব্ধি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতিশীলতা, গণতন্ত্র ও নির্বাচন, নাগরিকত্ব, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং নীতির প্রভাব এবং সমসাময়িক সমস্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল।
সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় ৬৯.৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, দেশ অর্থনৈতিকভাবে ভুল পথে রয়েছে। উত্তরদাতাদের ২৫.২ শতাংশ বলেছেন যে তারা সঠিক পথে আছেন। এর আগেও তারা একই জরিপ করেছিল। ২০১৯ সালে পরিচালিত একটি সমীক্ষায়, ৭০.৩ শতাংশ নাগরিক ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে রয়েছে এবং ২৮ শতাংশ মানুষ ভেবেছিল যে এটি ভুল পথে রয়েছে। কিন্তু এখন সেই মতামত অনেকাংশে উল্টে গেছে।
গবেষণা দেখায় যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানুষের জীবনযাত্রার মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জরিপ অনুযায়ী, এই সমস্যা দেশের ৮৪ শতাংশ মানুষের জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। কিছু প্রভাব ১৩ শতাংশ মানুষের জীবনে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে যাদের জীবনে কোনো প্রভাব পড়েনি মাত্র ১ শতাংশ মানুষ। এছাড়াও ২ শতাংশ মানুষ আছে যারা মোটেও এটা নিয়ে চিন্তিত হননি। ৪৪ শতাংশ মনে করেন, দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি।
২০১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সঠিক পথে ছিল বলে মনে করত ৭৭ শতাংশ মানুষ এবং ২১.৯ শতাংশ মনে করত ভুল পথে এগোচ্ছে দেশ। তবে ২০২২ সালে সঠিক পথে আছে বলে মনে করে ৫৭ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা। সেক্ষেত্রে সাড়ে ১৯ শতাংশেরই আস্থা কমেছে। এখন ভুল পথে রয়েছে বলে মনে করে ৩৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা আগের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি।
সিরডাপের পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলালউদ্দিন বলেন,” জরিপে বাংলাদেশের অর্থনীতির বাস্তব অবস্থাই প্রতিফলিত হয়েছে। দ্রব্যমূল্যই বাংলাদেশের মানুষকে এখন সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থায় ফেলেছে। আর অর্থনীতির সূচক দেখলেও স্পষ্ট যে বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথে যাচ্ছেনা।”
তিনি বলেন, ” এমন মনে হতে পারে এটা সাময়িক সমস্যা হচ্ছে, আমরা আবার সঠিক পথে উঠে যাবো। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা সাময়িক কোনো সমস্যা নয়। বৈদেশিক মুদ্রার চাপ সামলাতে গিয়ে আমরা আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছি। এর ফলে আমাদের দেশজ উৎপাদন কমে গেছে। রপ্তানি কমছে। বিনিয়োগ কমছে। কর্মস্থান কমছে। আমরা বেশি দামে বিদেশি পণ্য আনছি। সেইভাবে আমাদের পণ্য যাচ্ছেনা। তাহলে তো মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়তেই থাকবে।”
তার কথায়, “রাজস্ব আদায় ঠিক মত করতে না পেরে টাকা ছেপে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। রাজস্ব আদায় যে সহসাই বেড়ে যাবে তা নয়। তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে টাকা ছাপতে থাকলে তো মূল্য স্ফীতি আরো বাড়বে। টাকার মান তো কমতেই থাকবে।”
পলিসি রিসার্চার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ” ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দিয়ে আর কত চলবে? বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম কমে আসছে। আমাদের কমছেনা। ডাবের দাম, ডিমের দাম বাড়ার কী কারণ থাকতে পারে? আসলে আমাদের সঠিক নীতি নির্ধারণের অভাবে এই সংকট হয়েছে। আমার মনে হয় অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে। রিজার্ভের ওপর চাপ আরো বাড়বে। কারণ সংকট কাটাতে দৃশ্যমান কোনো নীতি আমরা দেখতে পাচ্ছিনা।”
তার কথায়, “জরিপে পাওয়া তথ্য সঠিক বলে মনে হচ্ছে। আমদানি কমছে, রপ্তানি বাড়ছে না, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, রেমিটেন্স কমছে, রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। ফলে অর্থনীতি খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে। আরও খারাপ হতে পারে। পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। এটা হঠাৎ না। এক বা দুই বছর ধরে পরিস্থিতি ক্রমাগত অবনতির দিকে যাচ্ছে।”
তবে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, “যারা বলে দেশের অর্থনীতি ভালো না, তারা আসলে অর্থনীতি বোঝে না। আমরা যখন যখন দায়িত্বে ছিলাম না, তখন মূল্যস্ফীতি ছিল ১২.২ শতাংশ ছিল। এরপর অধিকাংশ সময় ছিল ৯ শতাংশের মধ্যে, আদারওয়াইজ ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কে বলেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় আছে? বিশ্বে অর্থনীতি চাপে থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো চলছে। অবনতির মাত্রা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে।