চলচ্চিত্র অভিনেত্রীকে ফোনে খারাপ কাজ করার হুমকি এবং বেগম জিয়ার নাতনী জাইমা রহমানকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করার আলোচনায় আসেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। যার কারনে তিনি প্রতিমন্ত্রীর পদ হারান। এরপর তিনি নিজেকে আড়াল করার জন্য তিনি প্রথমে চট্টগ্রামে বন্ধুর বাসায় এবং এরপর তিনি বিনা বাধায় দেশ ত্যাগ করেছেন। তার বিদেশে যাওয়া প্রসঙ্গে সরকার বলছে, তার বিরুদ্ধে যেহেতু কোনো ধরনের মামলা নেই তাই তার দেশত্যাগেও কোনো বাধা নেই। তবে আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার যদি চাইতো তাহলে প্রশাসনিকভাবে তাকে দেশত্যাগে বাধা দিতে পারতো।
মুরাদ হাসানের অডিও প্রকাশের পর প্রবল নিন্দা ও সমালোচনার মুখে মুরাদ হাসান গত ৬ ডিসেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের নির্দেশ দেওয়ার পর তাকে আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি। তবে তিনি মাঝেমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি।
মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিলেও তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো মামলা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ঢাকার শাহবাগ থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করলেও তা এখনো রেকর্ড করা হয়নি। অন্যদিকে বিএনপি সারাদেশে মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিলেও এখনো কোনো মামলা করেনি বিএনপি।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘আমরা মামলার জন্য আমাদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছি। তারা মতামত দিলেই মামলা করব।’ তবে ডা. মুরাদ দেশ ছাড়ায় শুধু সরকারকেই দুষছেন তিনি, ‘সরকার একজন অপরাধীকে দেশের বাইরে যেতে সহায়তা করেছে। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে অনৈতিকতা, অশ্লী’লতা ও বিকৃত রুচির মানসিকতার অভিযোগ আছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের আবেদন আছে। তাই সরকার তাঁকে বিদেশ যেতে দিয়ে অপরাধীর পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। আর এখানে স্বজনপ্রীতিও স্পষ্ট।’
তবে আওয়ামী লিগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমার জানা মতে, তাঁর বিরুদ্ধে তো কোনও মামলা নেই। কোনও ওয়ারেন্ট বা বিধিনিষেধ নেই। সেক্ষেত্রে তো তিনি দেশের বাইরে যেতে পারেন। তিনি তো আগেও দেশের বাইরে ছিলেন।’ তাঁর বিরুদ্ধে যেহেতু অভিযোগ আছে, সেই অভিযোগের কারণে তাকে মন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয়েছে, সরকার চাইলে কি তার বিদেশে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দিতে পারত? এর জবাবে আওয়ামী লিগের এই নেতা বলেন, ‘তাঁর আপ’ত্তিকর কথাবার্তার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এমন তো অভিযোগ নেই যে সে রাষ্ট্রের কোনও ক্ষতি করে বা রাষ্ট্রের কোনো সম্পদ বা অর্থ আত্মসাৎ করে পালাচ্ছে। তাঁর চারিত্রিক অবক্ষয় ছিল, তাঁর জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানান, এরইমধ্যে জেলা আওয়ামী লিগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আওয়ামী লিগের পরবর্তী কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এটা নিয়ে আলোচনা হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘এখানে দুটি দিক আছে। যেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই এবং বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা নেই, তাই তাঁকে পু’লিশ দেশের বাইরে যেতে দিয়েছে। যদি নিষেধাজ্ঞা থাকত, তাহলে তো যেতে দিতো না। বিমানবন্দরে তথ্য থাকতে, আটকে দেওয়া হত। নিষেধাজ্ঞা যে নেই তিনি সেটা জেনেই বিমানবন্দরে গিয়েছেন। এটা তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বলেছেন।’ তাঁর কথায়, ‘সংবিধানে নাগরিকদের মুক্ত চলাফেরার অধিকার দেয়া আছে। কিন্তু যেহেতু তিনি গর্হিত কাজ করার হুমকি দিয়েছেন, ব’/র্ণবাদী কথা বলেছেন, তাই সরকার চাইলে তাঁর বিদেশে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থা করতে পারত। আর দুর্নীতির মামলা হলে জামিনে থাকলেও বিদেশে যেতে আদালতের অনুমতি লাগতে।’ তিনি বলেন, ‘সরকার এক্ষেত্রে বাধা দেয়নি। কিন্তু যদি বিরোধী রাজনীতির কেউ হতেন, তাহলে হয়ত সরকার তার গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে বিমানবন্দরে তথ্য দিয়ে রাখত। বিদেশে যেতে পারতেন না।’
নারী নেত্রী এবং মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘মামলা হোক বা না হোক সরকারের দায়িত্ব হল, এই ধরনের ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা, গ্রেফতার করা। সেটা না করে তাঁকে বিদেশে যেতে দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল, এখন তিনি যেখানেই থাকুন না কেন সেখান থেকে নিয়ে এসে বিচারের মুখোমুখি করা।’ তাঁর কথা, ‘এই ধরনের জ’ঘন্য কাজ যাঁরা করেন, নারীকে অবমাননা করেন, গর্হিত কাজ করার হুমকি দেন, তাদের রাষ্ট্রেরই উচিত আইনের আওতায় আনা।’
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, যে জেলা থেকে মুরাদ হাসানকে আওয়ামীলীগের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, সেটাও কার্যকর করা হবে কার্যনির্বাহী কমিটি যদি অনুমোদনের করে। তিনি এখনো একজন সাংসদ। সেটা তার থাকবে কি থাকবে না সেটা ভিন্ন বিষয়। কারণ দলটি যদি চূড়ান্তভাবে বহিষ্কার করে ডা. মুরাদ হাসানকে তবেই নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। সংবিধানে বলা আছে যে, কোনো সংসদ সদস্য যদি দল থেকে পদত্যাগ করেন কিংবা দলের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য কোনো দলের প্রার্থীকে ভোট দেন তাহলে তার সংসদ সদস্যপদ আর থাকবে না বাতিল হয়ে যাবে। বহিষ্কার করার পর কী হবে সেটা সংবিধানে বলা নেই। ফলে পদ ছাড়ার পর তার সংসদ সদস্য পদটিও থাকবে কিনা সেটা এই মুহূর্তে অজানা। আর আদালতে নৈতিক স্খলনের বিষয়টি প্রমাণিত হয় তাহলে তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়।
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন থেকে নেওয়া।