দারুন সুখবর, পাকিস্তানে রপ্তানি হবে বাংলাদেশের ওষুধ

বাংলাদেশের ওষুধশিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছে। এবার এই সাফল্যের পালক যোগ হতে চলেছে পাকিস্তানে ওষুধ রপ্তানির মাধ্যমে। ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ রবিবার (১৫ ডিসেম্বর) বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় এই সম্ভাবনার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, পাকিস্তান বাংলাদেশের ওষুধ আমদানিতে গভীর আগ্রহী এবং স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়াতে চায়।

হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে। আলোচনায় দুই দেশের সম্পর্ক, স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়ন এবং বাণিজ্যের প্রসারের বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে। পাকিস্তান মনে করে, বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের আন্তর্জাতিক মান এবং দক্ষতা এই খাতের উন্নয়নের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত সম্প্রতি অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধ এখন দেশের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। পাকিস্তানের হাইকমিশনার এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা ওষুধ পাকিস্তানের স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের ওষুধশিল্প অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল। আমরা আশা করি, এই খাত থেকে আমদানি করা ওষুধ আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের দ্রুত অগ্রগতি বৈশ্বিক পর্যায়ে নজর কেড়েছে। এই খাতটি দেশে প্রায় ৯৮% ওষুধের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রপ্তানি করছে। গুণগত মান এবং তুলনামূলক কম দামের জন্য বাংলাদেশি ওষুধ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছে।

বিশেষ করে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের উন্নয়নে ১৯৮২ সালের ঔষধ নীতি মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে। এই নীতি স্থানীয় উৎপাদনকারীদের উৎসাহিত করেছে এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া প্রভাব হ্রাস করেছে। এর ফলে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।

পাকিস্তান তাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়নে নতুন কৌশল গ্রহণ করছে। দেশটি মনে করছে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ থেকে ওষুধ আমদানি করলে মানসম্মত পণ্য পাওয়ার পাশাপাশি খরচও তুলনামূলক কম হবে। পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ আরও জানান যে, বাংলাদেশের সঙ্গে শুধু ওষুধ খাতেই নয়, স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত অন্যান্য ক্ষেত্রেও যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার মোহাম্মদ মারুফ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. মামুনুর রশীদ এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রপ্তানি শুধু অর্থনৈতিক লাভের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্যও একটি কার্যকর মাধ্যম। বর্তমানে বাংলাদেশি ওষুধ বিশ্ববাজারে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনে বাংলাদেশের দক্ষতা পাকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত উপকারী হতে পারে।

পাকিস্তানের স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশি ওষুধ অন্তর্ভুক্ত হলে এর বহুমুখী প্রভাব পড়তে পারে। এটি শুধু পাকিস্তানের জনগণের জন্য সাশ্রয়ী এবং মানসম্মত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করবে না, বরং বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের পথও সুগম করবে। উভয় দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা ও বাণিজ্যে এই সহযোগিতা একটি শক্তিশালী বন্ধনের সূচনা করবে বলে আশা করা যায়।

হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফের মতে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা আরও প্রসারিত করার জন্য উভয় দেশই প্রস্তুত। এই উদ্যোগের আওতায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তি বিনিময়, এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও সহযোগিতার সুযোগ রয়েছে।

পাকিস্তানের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের এই অগ্রগতির পেছনে সঠিক নীতি এবং উদ্যোগ কাজ করেছে, যা পাকিস্তানের জন্য একটি শিক্ষণীয় দিক হতে পারে।

পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের এই নতুন বাণিজ্যিক সহযোগিতা কেবলমাত্র ওষুধশিল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এটি দুই দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সম্পর্ককে আরও গভীর করবে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম আশা প্রকাশ করেন যে, এই উদ্যোগ সফল হলে দুই দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে।

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও শক্তিশালী করতে এ ধরনের রপ্তানি চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের এই যৌথ প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে একটি সফল স্বাস্থ্যসেবা মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মধ্যে ওষুধ রপ্তানির এই সম্ভাব্য চুক্তি দুই দেশের জন্যই লাভজনক হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটি নতুন একটি বাজার উন্মোচনের সুযোগ এবং পাকিস্তানের জন্য মানসম্মত ওষুধ আমদানির একটি কার্যকর সমাধান। এই উদ্যোগ দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করবে এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।


বাংলাদেশীদের যেভাবে গুম করতো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা

গুমের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি প্রকাশিত গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন থেকে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার পরিকল্পিত অপারেশন, নির্যাতন এবং হত্যা কৌশলের বিবরণ। বিশেষত, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

গুম কমিশনের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) বাংলাদেশে এক হাজার ৬৭৬টি গুমের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫৮টি ঘটনার তদন্ত করা হয়েছে। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হলেও ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ২১টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।

প্রতিবেদনে গুমের ঘটনা চিহ্নিত করতে চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে— ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে পরিবারের অজানা থাকা, ভিকটিমকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেওয়া। এ ছাড়া, গুমের ঘটনা পাঁচটি ধাপে সংঘটিত হয়েছে: অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা এবং লাশ গুম।

গুমের ঘটনার পেছনে দুটি প্রধান পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমত, ভিকটিমকে আটক করে নির্যাতনের মাধ্যমে অন্যদের তথ্য আদায় করা। দ্বিতীয়ত, প্রভাবশালী নেতার সরাসরি নির্দেশে অভিযান পরিচালনা।

গুমের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও ছিল সুপরিকল্পিত। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভিকটিমের অবস্থান চিহ্নিত করে অপহরণ করা হতো। তদন্তে জানা যায়, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এই নজরদারি পরিচালনা করত।

আটকের পর ভিকটিমদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিবরণ শিউরে ওঠার মতো। এক যুবককে কোনো ব্যথানাশক ওষুধ ছাড়াই ঠোঁট সেলাই করে দেওয়া হয়। এক ব্যক্তিকে যৌনাঙ্গে এবং কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। ভিকটিমদের সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে নির্যাতন করা হতো। কিছু কারাগার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যেখানে নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছিল।

এক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তাকে গুলি করে হত্যার আগে শারীরিকভাবে এতটাই অক্ষম করে দেওয়া হয়েছিল যে তার পক্ষে পালানো সম্ভব ছিল না। আরেকজনকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পালানোর চেষ্টা করার পর গুলি করে হত্যা করা হয়।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আটটি গোপন কারাগারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কারাগারে ভিকটিমদের নির্যাতন ও আটক রাখা হতো। এসব কারাগার পরিচালনায় ডিজিএফআই, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব), এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটক ভিকটিমদের বেশিরভাগ সময়ই রাতে অপহরণ করা হতো। তাদের চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া পরানো হতো। ভিকটিমদের দ্রুততার সাথে এমনভাবে অপহরণ করা হতো যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে।

গুমের শিকার বেশিরভাগ ভিকটিমেরই পরিণতি ছিল ভয়াবহ। অনেককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে এসব লাশ গুম করার ঘটনা বারবার উঠে এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে, সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে লাশ বাঁধা হতো যাতে লাশ ভেসে না ওঠে।

এছাড়া, হত্যার আগে ভিকটিমদের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কিছু ঘটনায় ভিকটিমদের মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আরেকটি ঘটনায়, এক ভিকটিমকে রেললাইনের ওপরে রেখে ট্রেন দিয়ে লাশটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়।

গুম থেকে ফিরে আসা ৭৩% ভিকটিম জানিয়েছেন, তারা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে তাদের পরিবারকেও সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে গুমের ঘটনাগুলো কেবল অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এর পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিশেষত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার কথা কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

গুমের পেছনে মূলত দুটি উদ্দেশ্য কাজ করত। প্রথমত, ভিকটিমদের নির্মূল করা। দ্বিতীয়ত, লাশ এমনভাবে গুম করা যাতে তা পুনরুদ্ধার বা শনাক্ত করা না যায়। এ ধরনের পরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত গুমের ঘটনাগুলো বাংলাদেশে একটি গভীর সংকট তৈরি করেছে।

গুম কমিশনের এই প্রতিবেদন বাংলাদেশে গুমের ভয়াবহ চিত্র এবং এর পেছনের কৌশল ও ষড়যন্ত্র উন্মোচন করেছে। এটি কেবল একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং এর পেছনে আন্তর্জাতিক সংযোগও রয়েছে। এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এখন প্রয়োজন যথাযথ তদন্ত ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, যাতে গুমের এই চক্র চিরতরে বন্ধ করা যায়।