Friday , January 10 2025
Breaking News
Home / Countrywide / ‘দরবেশ’ একাই লুটেছেন ৫৭ হাজার কোটি টাকা: বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র

‘দরবেশ’ একাই লুটেছেন ৫৭ হাজার কোটি টাকা: বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র

গত দেড় দশকে ব্যাংক ও আর্থিক খাত থেকে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি সালমান এফ রহমান। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিনি নিজের নামে ও বেনামে মোট ১৮৮টি প্রতিষ্ঠান থেকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

তথ্য অনুসারে, সালমান এফ রহমান ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং পুঁজিবাজার থেকে আরও ৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ব্যাংক থেকে নেওয়া এই ঋণের মধ্যে ২৩ হাজার ১২০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। শুধু নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানই নয়, তিনি বেনামি প্রতিষ্ঠান খুলেও এই অর্থ লুট করেছেন।

আর্থিক খাতে সালমান এফ রহমানের একচেটিয়া ক্ষমতার কারণে গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তিনি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তার প্রভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এই ব্যাংক থেকেই তিনি লুট করেছেন ২৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সোনালী, আইএফআইসি, রূপালী, ন্যাশনাল ও এবি ব্যাংক থেকে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, “রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যাংক ও বিমাসহ আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে লুট করা হয়েছে। সালমান শুধু ব্যাংক লুটেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; তিনি শেয়ারবাজারে কারসাজি করার জন্য সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনকেও ব্যবহার করেছেন।”

তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, কিন্তু সেগুলো দেখা যাচ্ছে না।”

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সালমানের ২৯টি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক থেকে ২৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার মধ্যে ১৯ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা এখন খেলাপি।

এই ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-কানুন মানা হয়নি। প্রথমে টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে, পরে কাগজপত্র তৈরি করে তা ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ অমান্য করে বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নতুন ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে জনতা ব্যাংক বেক্সিমকো গ্রুপের প্রায় ৮ হাজার ৫৮০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

সালমান এফ রহমান পুঁজিবাজারের অন্যতম কারসাজির হোতা। গত তিন দশকে তার কারসাজির কারণে অসংখ্য বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তিনি ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় ব্যক্তি এবং বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনে বাজারে কারসাজি করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সালমান এবং তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানসহ ৭৪ ব্যক্তি এবং বেনামি আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৬ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়েছে। এসব শেয়ার সাতটি ব্যাংকের ঋণের মাধ্যমে কেনা হয়।

আইএফআইসি ব্যাংক:
সালমান আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ২৯টি বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ঋণ নেওয়া হয়।

সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক:
এই তিন ব্যাংক থেকে তিনি ৩ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন, যার বেশিরভাগই খেলাপি।

ন্যাশনাল ব্যাংক:
৯টি প্রতিষ্ঠানের নামে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে নেওয়া ৩ হাজার ১৮২ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা খেলাপি।

এবি ব্যাংক:
এবি ব্যাংক থেকে সালমানের ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণ ১ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব অনিয়মের তদন্ত শুরু করেছে। ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে ঋণ নেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ লুটপাটের ঘটনায় সালমান এফ রহমান ও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।

এদিকে, বেক্সিমকো গ্রুপের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। সালমান বর্তমানে জেলে থাকায় তার বক্তব্যও নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে এই বিশাল লুটপাটের ঘটনায় অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, এই অনিয়মের সমাধানে দ্রুত ও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে আর্থিক খাতের অবস্থা আরও বিপর্যস্ত হবে।

About Nasimul Islam

Check Also

কৃষকদল নেতার জুয়ার আসরে অভিযান, আইনজীবী-কাউন্সিলরসহ গ্রেপ্তার ৯

ময়মনসিংহে এক জুয়ার আসরে অভিযান চালিয়ে আইনজীবী ও কাউন্সিলরসহ ৯ জনকে আটক করেছে যৌথ বাহিনী। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *