তুমি টাকা দাও, রিপোর্ট পাল্টে দেব। আর আপনার ছেলেকেও পুলিশ গ্রেফতার করবে না। বিষয়গুলি যত জটিল হবে, তত বেশি সমস্যা হবে। তুমি বুঝছ.’।
ভুক্তভোগী এক নারীর সঙ্গে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রাজিব সাহা এবং মোহাম্মদপুর থানার এসআই পবিত্র মণ্ডলের কথোপকথন এটি। কিশোরকে ব্ল্যাকমেইল করে ওই নারীর কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে পুলিশ।
দাবি অনুযায়ী টাকা না দেওয়ায় কিশোরীকে ধর্ষণের মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশের দুই ও তিন উপ-পরিদর্শকের বিরুদ্ধে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত আরেক ব্যক্তি হলেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই চয়ন।
গত ২৬ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এক ছেলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন এক মেয়ে। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় এসআই পবিত্র মণ্ডলকে। এর আগে ওই তরুণীর অভিযোগ পেয়ে প্রাথমিক তদন্ত পরিচালনা করেন এসআই চয়ন।
মামলা দায়েরের পর থেকেই পুলিশের সঙ্গে নানা তোড়জোড় শুরু হয়। অভিযুক্ত কিশোরের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কখনো আপস, কখনো মোটা অংকের টাকা দাবি করা হয় মেয়েটির মেডিকেল রিপোর্ট পাল্টানোর জন্য।
কিশোরীর মেডিকেল রিপোর্ট পরিবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে আসামি কিশোরীর মায়ের সঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ তিন পুলিশ সদস্যের কথোপকথনের রেকর্ডিং কালবেলার হাতে এসেছে। সেখানে ছেলেটির মা ৫০ হাজার টাকা দিতে রাজি হলেও এসআই রাজীব সাহা বলেন, তিনি (প্রাথমিক তদন্তকারী এসআই চয়ন) ৮০ হাজার টাকার কম নিতে রাজি নন। সে তো তোমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করবে। চয়ন লাইগা আছে তোমার ছেলেকে ধরার জন্য। র্যাব যাইয়া তোমার ছেলেরে ধইরা নিয়ে আসবে। রিপোর্ট আসলে তখন ওই মেয়ের সঙ্গেও বইসা লাভ নাই। তুমি বুঝো না—মেয়ে কেমন বাটপার? মেয়ের সাথে বসতে চাইলে মেয়ে যদি ৫ লাখ চায়, তখন ওইটাই দিতে হবে। তোমার ছেলের জন্য ভালো হবে বলে দিলাম।’
জানা যায়, মামলার বাদীর সঙ্গে অভিযুক্ত কিশোরীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তারা দুজনই নাবালক। জন্ম সনদ এবং স্কুলের রেকর্ড অনুযায়ী ছেলেটির বয়স ১৫ বছর এবং মেয়েটির বয়স ১৭ বছর ৯ মাস। তবে মামলার জবানবন্দিতে মেয়েটির বয়স ১৮ ও ছেলের বয়স ১৯।
জানতে চাইলে মামলার বাদী কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের সম্পর্কে ফাটল দেখা দিলে আমি বিষয়টি আমার এক বান্ধবীকে বলি। এরপর সে আমার সঙ্গে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) চয়নের সোর্স হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর চয়ন স্যারের কথামতো হৃদয় আমাকে দিয়ে থানায় একটি অভিযোগ দেওয়ায়। ওইদিনই এসআই চয়ন স্যার আমাকে নিয়ে ওই ছেলের বাসায় যায়। বাসায় গিয়ে ছেলের মাকে বিষয়টি জানাই। সব শুনে তিনি আমাকে মেনে নিতে রাজি হন। পরে আমি অভিযোগ উঠিয়ে নিতে চাইলে পুলিশ সেটা করতে দেয়নি। মেডিকেল টেস্টের নাম করে আমাকে ওইদিন সারারাত থানায় আটক করে রাখে পুলিশ। আমার বাসায় মা চিন্তা করবে বললেও তারা আমাকে ছাড়েননি। সকালে আমাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে টেস্ট করানোর পর ছাড়ে। পরে শুনি, আমার অভিযোগটি মামলা হয়ে গেছে। পরে আমি আরও জানতে পারি, তারা আমাকে হাতিয়ার বানিয়ে ওই ছেলের মায়ের কাছে টাকা দাবি করেছে।’
জানা যায়, ওই মামলার ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার রাতে এসআই পাবড়ি মণ্ডলের নেতৃত্বে ওই কিশোরের বাড়িতে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় ছেলের মাকে বেডরুমে ঢুকে মারধর করা হয়। তার শরীর থেকে কাপড় ছিঁড়ে গেছে।
সেই সময়ের একটি অডিও এসেছে কালবেলার হাতে। শোনা যাচ্ছে, ছেলের মায়ের বেডরুমে ঢুকে তার ভিডিও তুলছিলেন এসআই পবিত্র মণ্ডল। পরে ওই নারী রুম থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। তবে পুলিশ তার তোয়াক্কা না করে বেডরুমের ভিডিও করা শুরু করে। এ সময় ওই নারী বারবার তাকে তার সন্মান নিয়ে ভিডিও করতে নিষেধ করেন। এরপর ওড়না পরে বাইরে আসছেন জানিয়ে পুলিশকে রুম থেকে বের হতে বলেন ওই নারী। একপর্যায়ে অডিওতে ওই নারীর চিৎকার শোনা যায়।
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ছেলেটির মা আসমা আক্তার কালবেলাকে বলেন, “রাতে এসআই পাওয়ার আমার বাসায় গিয়ে বেডরুমে প্রবেশ করে। এ সময় তার সঙ্গে থাকা এক আনসার আমাকে লাথি মেরে ঘরের দরজা ভেঙে দেয়। এরপর আমি তাকে বললাম, তুমি বাইরে যাও, আমি উরনা পরে আসছি। সে আমার কথা না শুনে আমার গায়ে হাত দিল। তারপর তারা আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল।’
তিনি আরও বলেন, “এসআই রাজীব ও এসআই পবিত্রা আমার কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করেছে। এ ব্যাপারে এসআই রাজীব আমার সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেছেন। টাকা না দেওয়ায় আমি আমার ছেলের নামে মিথ্যা মামলা করেছে। মামলার পরও তারা মীমাংসার জন্য টাকা দাবি করে। তিনি আরও বলেন, টাকা দিলে মেয়ের মেডিকেল রিপোর্ট উল্টে দেবেন। তা না হলে আমার ছেলেকে আটকের হুমকি দেন।পরে আমার বাড়িতে ঢুকে ছেলেকে তুলে নিয়ে যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোহাম্মদপুর থানার এসআই চয়নের সোর্স হিসেবে পরিচিত হৃদয় প্রথমে চয়নকে বিষয়টি জানায়। পরে মামলা দায়েরের আগে চয়ন মেয়েটিকে নিয়ে ওই কিশোরের বাড়িতে গিয়ে মীমাংসা করার চেষ্টা করে।
তৃণমূল সম্পৃক্ততা করার সঙ্গে ক্ষমতাসীন এসআই রাজিব কালহাবেলাকে বলেন, ‘আসলে বিরোধিতা আমার নয়। আমি টাকা-পয়সার বিষয়ে কোনো কথা বলি না। আর আমি এখন মোহাম্মদপুর নাই, আমি এখন তেজগাঁও শিল্পে।
এই ঘটনায় জড়িত না থাকলে গত মঙ্গলবার ওই কিশোরের মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রাজিব সাহা বলেন, ‘ওই মহিলা আমার পূর্বপরিচিত। ওই মহিলা ফোন দিয়ে আমার কাছে হেল্প চাইছিল। বলছে, তার ছেলের নামে একটি মামলা হয়েছে। এই বিষয়ে আমি তাকে হেল্প করতে গেছিলাম। তবে টাকা-পয়সার বিষয়ে তার সাথে আমার কোনো কথা হয় নাই।’
৮০ হাজার টাকা দাবি করার অডিও রেকর্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে আমি কোনো টাকা-পয়সা চাই নাই। এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
এ ঘটনায় আরেক অভিযুক্ত এসআই পবিত্র মণ্ডলকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল নম্বরে মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর দেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে মহম্মদপুর রাজনীতি ইনচার্জ (ওসি মাহফুজুল) সমস্যা কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনার কাছেই প্রথম শুনলাম।
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিযোগ করার পরে বাদী-বিবাদীর মধ্যে আপস-মীমাংসা হওয়া যায়। পরে উল্টাপাল্টা কথা বলতে পারে। এগুলো ভিত্তিহীন কথাবার্তা। তাই সত্য-মিথ্যা ফল-বাছাইয়ের বিষয় আছে।