সে অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল যে আজ আমাদের মধ্যে এমন একটি দিন আসবে। মানুষ চিনতে তার ভুল হয়নি।যাদের জন্য এতো কিছু করেছেন,জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় দিয়েছেন, হাতে কলমে শিখিয়েছেন, তাঁরা এখন খেয়াল করেন না। এখন তাদের আর কোনো আগ্রহ নেই। আমরা তাদের নিজেদের মনে করতাম কিন্তু মারা যাওয়ার আগে তিনি সিনেমার পছন্দের মানুষদের নিয়ে এগুলো বলে গিয়েছিলেন। তাই আমাদের কোনো আফসোস নেই, বলেছেন অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের স্ত্রী রুনি জামান।
আজ বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানের জন্মদিন। গত বছর তার মৃত্যুর পর, অভিনেতার পরিবারের সদস্যরা বিশেষ দিনগুলির জন্য অপেক্ষা করে — অভিনেতার সহকর্মী, সিনেমার প্রিয়জনরা তাদের খোঁজ করবেন; কিন্তু দিন যায়, প্রতিবারই হতাশ হতে হয়।। রুনি জামান বলেন, ‘তার হাত থেকে অনেকেই নির্দেশনা ও চিত্রনাট্য শিখেছেন। কতদিন তারা আমাদের বাড়িতে কাটিয়েছে? সবাইকে পরিবারের একজন মনে করতাম। আমাদের এখন কেউ মনে রাখে না। আমরা পরিচিত মানুষদের সাথে দেখা করতে পছন্দ করি। তিনি মনে করতেন সিনেমার মানুষগুলো আমাদের পরিবারের সদস্য।
এটিএম শামসুজ্জামান ছোটবেলায় মঞ্চ নাটক দিয়ে অভিনয় শুরু করেন। পরে বুঝতে পারলেন চলচ্চিত্রই তার আসল জায়গা। কিন্তু ছবিটি যে তাকে বিশাল খ্যাতি এনে দেবে তা কখনো ভাবেননি। তাঁর মৃত্যুর পরও ভক্তরা তাঁর বাড়িতে খোঁজখবর নিতে আসেন। কবরের সামনে কেউ যায় জেয়ারত করে আসে। রুনি জামান বলেন, জুরাইনে তার সমাধিতে এখনো ভক্তরা ভিড় জমায়। পরিবারের সদস্যরা কবরস্থানে গেলে ভক্তরা তাদের প্রিয় অভিনেতার জন্য প্রার্থনা করতে দেখেন।
ক্ষুব্ধ রুনি জামান বলেন, প্রথম দিকে তিনি চেয়েছিলেন, তাঁকে যেন আজিমপুর বা অন্য কোথাও দাফন করা হয়। লাশ এফডিসিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শেষ পর্যন্ত ভক্তরাই তাঁকে মনে রাখবেন। মারা যাওয়ার আগেই বলে গেছেন জুরাইনে দাফনের কথা। তিনি জানতেন, মারা যাওয়ার পর অনেকেই লাশ বিভিন্ন স্থানে নেওয়া কথা বলবে। তখন ভালোবাসা দেখাবে। সে জন্য বলে গিয়েছিলেন, “আমার লাশ ঘর থেকে যেন অন্য কোথাও না যায়।
এটিএম শামসুজ্জামান ছিলেন আধুনিক মনের মানুষ। ঢালিউড চলচ্চিত্রে অভিনয়কে পেশা হিসেবে সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়া কয়েকজনের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। এসময় তিনি তার ব্যস্ততার মাঝেও সমিতির কার্যক্রম গতিশীল করতে সময় ব্যায় করেছেন। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সভায় সবাইকে খাওয়ানোর টাকা তার (এটিএম শামসুজ্জামান) কাছে ছিল না। এ জন্য বাসা থেকেই গরুর মাংসের কাবাব তৈরি করতাম। এ সময় আনোয়ার সাহেব, হাসান ভাই, মোস্তফা সাহেব, রাজীব, মিজু আহমেদসহ আরও অনেকে বৈঠকে ছিলেন। মিটিংয়ে খাবার খাওয়া একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তখন সমিতির সভা-সমাবেশে অনেকেই বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতেন। সমিতি কীভাবে শিল্পীদের সম্মান বাড়বে, কীভাবে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করা হতো। তিনি হয়ে ওঠেন একজন সম্পূর্ণ সিনেমার মানুষ। আজও সেই সমিতির কেউ খবর নিল না,’ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বলেন রুনি জামান।
এটিএম শামসুজ্জামান মানেই শুটিংয়ে প্রচুর ভিড়। দূরদূরান্ত থেকে শুটিং দেখতে আসতেন অনেকেই। কেউ খাবার নিয়ে এসেছে, কেউ উপহার দিয়েছে। বাড়িতে রাতের খাবার টেবিলে, ঘুমন্ত অবস্থায় স্ত্রী-সন্তানদের সেসব গল্প শোনাতেন অভিনেতা। কিন্তু তার স্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারি ছিল যে তাকে সময়মতো খেতে হবে। যে কারণে সময়মতো খাওয়ার অভ্যাস ছিল এই অভিনেতার। তিনি বেশিরভাগ সময় গরম খাবার খেতে পছন্দ করতেন। শেষ দিকে সেই গরম খাবার চাইতেন না তিনি কেবল চেয়েছিলেন যে তার স্ত্রী সর্বদা তার পাশে থাকবে।
সেই কথাগুলো মনে করিয়ে দিয়ে রুনি জামান আরও বলেন, ‘শেষ সময়ে একা থাকতে ভয় পেতেন। আমাকে একটুও সরতে দিতেন না। তিনি বললেন, “তুমি জানো না, আমার ভয় হয়। একদিন রান্না করে ফ্রিজে রেখে চার দিন খাব।” যে মানুষ ফ্রিজের খাবার পছন্দ করেন না, তাঁর এমন কথায় আমরা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তিনিও বুঝতে পেরেছিলেন, হয়তো আর সময় নেই।