সরকারি পদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিষয়টি মাঝেমধ্যে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে। তবে তাদের যেটুকু দুর্নীতির বিষয় মাঝে মধ্যে সামনে আসে তার থেকে অনেক বেশি দুর্নীতি করে থাকে, যেটা অন্তরালে রয়ে যায় রয়ে যায়। অনেক সময় তারা দুর্নীতি ঢাকতে তারা অন্যদেরকেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে ফেলেন, তখন তার সমর্থকেরাও তার সুরে কথা বলেন। এবার তিতাসের একজন উপ মহাব্যবস্থাপকের দুর্নীতির তথ্য উঠে এলো বিদ্যুৎ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে।
রাজধানীর গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে তিনটি এয়ার কন্ডিশনার (এসি) চালান তিনি। এছাড়াও ফ্যান, লাইট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস রয়েছে। এত ব্যবহার করার পরও তার মাসিক বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে ‘জিরো ইউনিট’। ১০ মাস ধরে তিনি সংযোগের জন্য ন্যূনতম চার্জ ২০৯ টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছেন। এর আগে তিনি তিন মাসের জন্য ১ ইউনিট করে খরচ বাবদ ২১৪ টাকা দিতেন।
ব্যাপক পরিমান বিদ্যুৎ ব্যবহার করে বিল দেওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া ওই ব্যক্তির নাম আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ। তিনি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (উপমহাব্যবস্থাপক)। তিনি মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। গুলশানে তিতাস গ্যাস অফিসার্স কোয়ার্টার্সের একটি ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে থাকতেন তিনি। বর্তমানে চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে আছেন।
ওই ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে একই কোম্পানির একজন নিরাপত্তা প্রহরী থাকেন। তিনি বাসায় একটি ফ্যান ও লাইট ব্যবহার করেন। কিন্তু ওই মাসে যখন সালেহ মাহমুদ শরীফের বিদ্যুৎ খরচ শূন্যের কোঠায়, তখন তার বিদ্যুৎ বিল ১৬,০০০ টাকা থেকে ২২,০০০ টাকা এসেছিল।
তিতাস গ্যাস সূত্রে জানা গেছে, অফিসার্স কোয়ার্টারের নিচতলায় সব কক্ষের বিদ্যুৎ বিল এবং যেসব ফ্ল্যাট খালি আছে সেগুলোর বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করে তিতাসের স্টেশন কন্ট্রোল শাখা। আর কর্মকর্তারা নিজেরাই বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেন। আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ যে ভবনে থাকেন সেখানে পাঁচটি মিটার দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। ২০ জুন স্টেশন কন্ট্রোল শাখা থেকে আবু সালেহ মাহমুদ শরীফের শূন্য বিল ও কম বিল পরিশোধের বিষয়টি জানানো হয়। সেখান থেকে জানা যায়, আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ ২৭ নভেম্বর ২০২০ থেকে ৪ মার্চ পর্যন্ত কোয়ার্টারের তৃতীয় তলায় ওই ফ্ল্যাটে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। পরে ৫ মার্চ ফ্ল্যাটটি সংস্কার করতে চতুর্থ তলায় উঠেন। . তৃতীয় তলায় থাকায় তার বিদ্যুৎ বিল ছিল অস্বাভাবিক ও অনিয়মিত। এর মধ্যে মিটারে দেখা গেছে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ১০ মাস কোনো বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়নি। একই সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীর বিল উঠেছে ২২ হাজার টাকা। কিন্তু আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ চতুর্থ তলায় ওঠার পর বিদ্যুৎ বিল বেড়ে ১২–১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
আবু সালেহ মাহমুদ শরীফের বিদ্যুৎ বিলের এই অসঙ্গতি খতিয়ে দেখতে গত ১৯ জুলাই তদন্ত কমিটি গঠন করে তিতাস গ্যাস লিমিটেড। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হলেও তারা এখনো তা জমা দেয়নি।
আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, আমার বিদ্যুৎ বিল নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। আমার পিছনে আমি আমার সামনে একটি প্রচার আছে. আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি সেই ফ্ল্যাটে যাওয়ার জন্য কেউ এই সব নোংরা কাজ করছে। বাড়ির বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বাড়িতে তিনটি এসি, লাইট ও ফ্যান রয়েছে।
তাহলে কিভাবে আপনার বিদ্যুতের খরচ প্রতি মাসে শূন্য ইউনিট হয় এবং আপনি কেন এই অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিলটি রিপোর্ট করেননি- প্রশ্ন করা হলে আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ বলেন, ‘দেখার জন্য অন্য অনেক সংস্থা আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি আমার কোম্পানির শুদ্ধাচার বিষয়ক ফোকাল পয়েন্ট। এবার ১৩টি কোম্পানির পক্ষ থেকে আমরা শুদ্ধাচার পুরস্কার পাচ্ছি। আমরা প্রথম হয়েছি।’
তার বিদ্যুৎ বিলের বিষয়ে কিছু না বললেও আবু সালেহ মাহমুদ শরীফ নিচতলায় বিল বেশি কেন তার পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, নিচতলায় ২৫টি লাইট ও তিনটি ফ্যান রয়েছে। এর জন্য আরও বিল এসেছে।
তবে তিতাস গ্যাস স্টেশন নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রকৌশলী তার বক্তব্য নাকচ করে দেন। মাহিদুর রহমান বলেন, কীভাবে একটি ঘরে ২৫টি বাতি জ্বালানো যায়? তিনি বলেন, আবু সালেহ মাহমুদ শরীফের বাড়ির মিটার ছিল ‘মাদার মিটার’। যদি মিটার নষ্ট হয়ে যায় এবং আপনি প্রায় এক বছর ধরে বিল পরিশোধ না করেন, তাহলে কেন রিপোর্ট করবেন না? আর ভাঙা না হলে অবশ্যই ‘মিটার টেম্পারিং’ হবে। তার বাড়িতে তিন-চারটি এসি চলে। এতে কোনো বিদ্যুৎ বিল আসেনি। আর যিনি নিরাপত্তা কর্মী, তার বিল আসে ২২ হাজার টাকা।
প্রকৌশলী মহিদুর রহমান জানান, আবু সালেহ মাহমুদ শরীফের মিটার পরিবর্তনের পর তার বিদ্যুৎ বিল এসেছে ১৩ হাজার টাকা। তিনি বলেন, এখন সবকিছু নির্ভর করছে তদন্ত কমিটি কী প্রতিবেদন দেয় তার ওপর। এত বড় ফ্ল্যাটে তিনটি এসি ব্যবহার করলে বিল শূন্য ইউনিটে আসবে কেন?’
ঘটনা তদন্তে তিতাস গ্যাসের আহ্বায়ক হিসেবে তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছে কোম্পানির উপ-মহাব্যবস্থাপক (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ) মোঃ সফিকুল ইসলামের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন কেন জমা দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। তদন্তে কী পাওয়া গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিল কেন আসেনি বা কেন কম এসেছে তা আমরা খতিয়ে দেখছি।’ রিপোর্ট কবে দেবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিগগিরই দেব।
এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব ও উপ-ব্যবস্থাপক (পরিবেশ ও নিরাপত্তা শাখা, পরিকল্পনা বিভাগ) সাবরিনা আফরিন বলেন, আমরা আমাদের কাজে খুব ব্যস্ত, তদন্তের অতিরিক্ত চাপ, তাই দেরি হচ্ছে। ” তদন্ত কমিটির অপর সদস্য প্রকৌশলী মোস্তাক মাসুদ মো. ইমরান (ব্যবস্থাপক, পাইপ ডিজাইন শাখা) বলেন, ‘আমি একজন সদস্য, বেশি কিছু বলতে পারছি না। ডাকলেই যাই।
তবে এ বিষয়ে যে দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে সেটা অনেকটাই স্পষ্ট। তার এই দুর্নীতির বিষয়টি রাখঢাক করতেই অন্যান্য কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে অজুহাত দিয়ে কথা বলছেন। এদিকে উপ-মহাব্যবস্থাপক জানান তার পদোন্নতি ঘটবে সেটা বন্ধ করতেই তাকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা কোনো একটা গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কর্মকাণ্ড তার উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।