বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের কেবিন নং ৬০৩। হাসপাতালের বেডে শুয়ে বারবার ভয় ও উদ্বেগে আঁতকে উঠছিলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈম। তার মনে সবসময় আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত শনিবার রাতে পুলিশ তাকে শাহবাগ থানায় ডেকে পিস্তলের বাট দিয়ে উপর্যুপরি ঠোঁট, দাঁত, মাথা ও নাকে আঘা”ত করেন পুলিশ সদস্যরা। নির্যা”তনের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
সেদিনের ভয়াবহ নির্যাতনের কথা বর্ণনা করেন আনোয়ার হোসেন নাঈম। তার কথায়, ছাত্র লীগ পরিচয় দেওয়ার পরপরই মারধর শুরু হয়। একপর্যায়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদসহ শাহবাগ থানার ওসি (তদন্ত) কক্ষে ১০-১২ জন পুলিশ আমাকে মারধর শুরু করে। তাদের সবার মুখে কাপড় বাঁধা ও ইউনিফর্ম থেকে নেমপ্লেট খোলা ছিল।’
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাঈম আরও বলেন, এডিসি হারুনের সঙ্গে তার কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক মামুন তার এলাকার বড় ভাই। তাদের বাড়ি গাজীপুরে। মামুনের ফোন পেয়ে থানায় যান নাঈম। থানায় গিয়ে ওসি-তদন্ত কক্ষে প্রবেশের পর ছাত্রলীগ পরিচয় দিতেই এডিসি হারুন তার ওপর অতর্কিত হাম”লা চালান। সেখানে মোস্তফা নামে একজন তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন, তিনিও অনেক মার”ধর করেন। এক পর্যায়ে তাকে মারধর করে অচেতন করে ফেলেন। নিচে পড়ে যাওয়ার পর অ”/স্ত্রের বাট দিয়ে ঠোঁট থেতলে দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের পরিচয়ে আরও ক্ষুব্ধ হন এডিসি হারুন।
ছাত্রলীগের এই নেতা বলেন, শাহবাগ থানার ওসি (তদন্ত) আমার মুখে কাপড় বেঁধে মা”রধর শুরু করেন। যেন আমি তাকে চিনতে না পারি। একপর্যায়ে আমি আমার হাত দিয়ে তার মুখের কাপড় খুলে চিনতে পারি। ওই সময় এডিসি হারুন ছাড়া ওই ঘরে থাকা ১০-১২ জন পুলিশ যারা আমাকে মারধর করছিল তাদের সবার মুখে কাপড় বাধা ছিল এবং তাদের ইউনিফর্মের নেমপ্লেট খোলা ছিল।
যে কাউকে যখন-তখন মারধর করা এডিসি হারুনের নেশা উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাকে বদলির ঘটনায় আমি সন্তুষ্ট নই। আমি তার বহিষ্কার চাই এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে হারুনের গ্রেফতার দাবি করছি।
এডিসি হারুন ও ওসি (তদন্ত) ছাড়াও সেখানে উপস্থিত বাকি পুলিশ সদস্যদের তিনি চিনতে পেরেছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মুখে কাপড় বাঁধা ছিল, তাই অন্য কাউকে চিনতে পারিনি।
ওই রাতে শাহবাগ থানার ওসি (তদন্ত) কক্ষে পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ মারধর করেন বলে অভিযোগ করেন এই ছাত্রলীগ নেতা। পরে ছাত্রলীগের অন্য নেতাকর্মীরা গিয়ে আহত নেতাদের থানা থেকে উদ্ধার করে।
আহত তিন নেতা হলেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈম, বৈজ্ঞানিক বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখার সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তাদের মধ্যে নাঈম বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। অন্যরা চিকিৎসার পর হলে ফিরে গেছেন।
গতকাল রোববার সকালে থানা হেফাজতে ছাত্রলীগ নেতাদের মা”রধরের বিষয়টি সামনে আসে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে এডিসি হারুনের বিচার দাবি করেন।
সমস্ত মোবাইল ডেটা মুছে ফেলা হয়-
আনোয়ার হোসেন নাঈম বলেন, থানায় ঢোকার সময় আমাদের মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। মোবাইলগুলো ফ্ল্যাশ (তথ্য মুছে ফেলা) দেওয়া হয়। মোবাইলের ছবি, ভিডিও বা কোনো নম্বরও নেই।
মারধরের সময় এডিসি শাহেন শাহের ভূমিকা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি এসে কোনো মারধর করেননি।
ঘটনার পরপরই আহত নাঈমকে প্রথমে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে রোববার সকালে সেখান থেকে তাকে সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে ওইদিন বিকেলে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নেওয়া হয়।
আহত ছেলের পাশে মলিন মুখে বসে ছিলেন নাঈমের মা নাজমুন নাহার। তিনি বলেন, আমার ছেলে তার এক পরিচিত ভাইকে খুঁজতে গিয়েছিল। কিন্তু বিনা কারণে পুলিশ তাকে মারধর করল কেন? আমার ছেলেকে মে”রে ফেলার জন্য এডিসি হারুন এভাবে পিটিয়েছে। আমার ছেলে কথা বলতে পারছে না, ব্যথার কারণে কিছু খেতে পারছে না। ডাক্তার বলেছেন শক্ত খাবার দেওয়া যাবে না। সব খাবারই কয়েকদিন গিলতে হবে। একজন মা হিসেবে আমি তার কষ্ট দেখতে পারছি না।
নাঈমের মা আরও বলেন, আর কোনো মায়ের সন্তানকে যেন এভাবে মার খেতে না হয়। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এডিসি হারুনের বিচার চাই। আমার ছেলে মানুষের উপকার করতে গেছে। কোনো মানুষ এভাবে মানুষকে পেটাতে করতে পারে না।