নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দশমবারের মতো ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিরোধী দল বিএনপি।
বুধবার সকাল ৬টা থেকে শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সারাদেশে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত নয় দফা অবরোধ ও হরতাল করেছে দলটি।
কিন্তু পর্যায়ক্রমে ঘোষিত এই কর্মসূচির শুরুতে যতটা কার্যকরভাবে পালন করতে দেখা গেছে, শেষ দুই দফায় তা দেখা যায়নি। কিন্তু তারপরও কেন এই কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি?
২৮ অক্টোবর থেকে বিএনপি মোট ১০টি হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তাদের কর্মসূচির শুরুতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে যানজট কম ছিল। দূরপাল্লার বাস বন্ধ থাকায় দোকানপাটও কম খোলা ছিল।
তবে গত কয়েক দফায় বিশেষ করে গত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হরতাল-অবরোধের প্রভাব কমতে থাকে।
সোমবার যখন বিএনপির নবম দফা অবরোধ কর্মসূচি চলছে, তখনও সারাদেশে জনজীবন স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে।
সন্ধ্যায় দুটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে, তবে অবরোধ সত্ত্বেও সোমবার দূরপাল্লার যান চলাচল স্বাভাবিক হতে দেখা গেছে। এছাড়া দোকান-পাট-শপিংমলগুলোও যথারীতি খোলা রয়েছে।
তবে সারাদেশে তাদের ঘোষিত হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি সফলভাবে পালিত হচ্ছে বলে মনে করছে বিএনপি।
দলটির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, “সরকার র্যাব-পুলিশকে ব্যবহার করে আমাদের নেতা-কর্মীদের নির্যাতন করছে এবং সারাদেশে আমাদের কর্মীদের বাড়িতে হামলা করা হচ্ছে।”
“তবে এই পরিস্থিতিতেও আমাদের নেতা-কর্মীরা যেভাবে মাঠে থেকে আমাদের কর্মসূচি সফল করে চলেছেন, সেটাই আমাদের শক্তি। নেতাকর্মীদের এই শ্রম ও ত্যাগ বৃথা যাবে না,” বলেন তিনি।
শুরুতে হরতাল-অবরোধে সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়াসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
বিএনপির লাগাতার হরতাল-অবরোধের শুরুতে সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়াসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
নেতাকর্মীরা মাঠে নেই
নেতাকর্মীরা মাঠ থেকে সক্রিয়ভাবে কর্মসূচি পালন করছেন বলে জনাব রিজভীর পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও বাস্তবে তাদের উপস্থিতি তেমন একটা দেখা যায়নি।
বরং বিএনপির নেতাকর্মীদের বড় অংশই এখন গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে। ফলে হরতাল-অবরোধ এখন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আমরা হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়েছি।
তিনি বলেন “আমাদের কর্মসূচির অন্যতম উদ্দেশ্য হল জনগণকে জানানো এবং তাদের বোঝানো যে এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। আমি মনে করি আমরা সফলভাবে এই বার্তাটি জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারব।
এদিকে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে একই কর্মসূচি দেওয়াকে বিএনপি নেতৃত্বের দুর্বলতা হিসেবে দেখছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবায়দা নাসরীন বলেন, “বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতাকে ২৮ অক্টোবরের পর গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দলের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ নেতা এখন কারাগারে। ফলে মনে হচ্ছে, এক ধরনের নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। বিএনপিতে শূন্যতা দেখা দিয়েছে। শীর্ষ নেতারা বাইরে থাকলে হয়তো সবাই মিলে নতুন কর্মসূচি ঠিক করতে পারতেন।
লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি বিএনপির জন্য নতুন নয়। এর আগেও দলটি লাগাতার হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু সেটা আট বছরেরও বেশি আগের কথা।
৫ জানুয়ারী, ২০১৪-এ দশম জাতীয় পরিষদ নির্বাচন বর্জন করার পর, দলটি ২০১৫ সালে সেই নির্বাচনের প্রথম বার্ষিকীতে টানা নয় মাস ধর্মঘট করে।
হরতাল এক পর্যায়ে সহিংস রূপ নেয়। একের পর এক বাসে আগুন ও পেট্রোল বোমা বিস্ফোরণে বহু মানুষ আহত হয়েছে, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এরপরও হরতাল অব্যাহত থাকায় কর্মসূচিগুলো এক পর্যায়ে তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
ফলে একপর্যায়ে কর্মসূচি স্থগিত করে দলটি।
বিএনপি কি বিকল্প কিছু ভাবছে?
গত ২৮ অক্টোবর থেকে দুই দিনের বিরতি দিয়ে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি।
শুরুতে হরতাল-অবরোধে সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়াসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে সহিং”সতার ঘটনা ঘটে। এছাড়া শতাধিক গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
এসব ঘটনায় পাঁচ শতাধিক মামলায় ১৮ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এছাড়া গ্রেফতার এড়াতে দলটির অনেক নেতাকর্মী পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে নেতাকর্মীদের মাঠে খুব কমই দেখা যাচ্ছে।
এই বাস্তবতায় হরতাল-অবরোধ ছাড়া নতুন কর্মসূচি ঘোষণার কথা ভাবছে বিএনপি?
সময়ের প্রয়োজনে বিএনপি নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ করে। শীর্ষ নেতারা আলোচনা করে ঠিক করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে হরতাল-অবরোধকে জনগণের ভোটের অধিকার আদায়ের সঠিক উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “সাধারণ মানুষও আমাদের সমর্থন করছে। তারপরও যদি নতুন কর্মসূচির প্রয়োজন মনে করা হয়, তাহলে শীর্ষ নেতাদের সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
এদিকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, নতুন কর্মসূচি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত হরতাল-অবরোধ চলবে।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নতুন কর্মসূচির বিষয়ে শীর্ষ নেতারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে আমার মনে হয় নতুন কর্মসূচি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।”
তফসিল ঘোষণার আগেও বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন কর্মসূচির বিষয়টি বেশ আলোচিত ছিল। তখন শোনা গিয়েছিল তফসিল ঘোষণার পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে দলটি।