পাঁচ দশকের দীর্ঘ বিরতির পর পাকিস্তানের একটি পণ্যবাহী জাহাজ গত মাসে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। এই ঘটনা বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্স্থাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশ করে, যা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই ধরনের উন্নয়ন দ্রুত গতিতে ঘটছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। হাসিনা তার দুই মেয়াদে ভারতের সাথে গভীর সম্পর্ক বজায় রাখলেও তার পদত্যাগ এবং বর্তমানে নয়াদিল্লিতে তার আশ্রয় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ:
শেখ হাসিনার আওতায় ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিল। হাসিনা ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে দেননি এবং ভারতীয় বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন। এর বিপরীতে, ভারত হাসিনার শাসনকালকে সমর্থন করতে গণতন্ত্রের অভাব উপেক্ষা করেছিল। কিন্তু হাসিনার প্রস্থানের পর এই সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশে অভিবাসন নিয়ে ভারত সবসময়ই চাপে ছিল। বিশেষত ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। বিজেপি অভিবাসন ইস্যুকে ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে যুক্ত করে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। বর্তমানে সীমান্ত অঞ্চলে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন এবং দুই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের প্রসঙ্গে উভয় দেশের মধ্যকার সমঝোতার অভাব উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে একজন হিন্দু সন্ন্যাসীর গ্রেপ্তার এবং তা ঘিরে উত্থাপিত বিক্ষোভ দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগ-প্রত্যঅভিযোগ বাড়িয়েছে।
নদী নিয়ে বিরোধ:
১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হলেও তিস্তা নদীর পানি নিয়ে বিরোধ এখনো মীমাংসিত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই চুক্তিতে সম্মতি না দেওয়ার ফলে বিষয়টি ভারতের জন্য একটি কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে রয়ে গেছে। বাংলাদেশে এই ইস্যুটি ভারতবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
ইসলামপন্থীদের উত্থান এবং ভারতের উদ্বেগ:
বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি এবং তাদের ভারতবিরোধী মনোভাব ভারতের জন্য আরেকটি বড় উদ্বেগের কারণ। বিশেষত জামায়াতে ইসলামী দল যদি বিএনপির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
ভারতের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের অধিকার। শেখ হাসিনার শাসনকালে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষায় কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস:
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের এই পরিবর্তনশীল পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠন প্রয়োজন। হাসিনার অনুপস্থিতিতে এবং বিএনপির সম্ভাব্য ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষিতে ভারতের প্রভাব কমতে পারে। এছাড়া, বাংলাদেশে ভারতের মিত্র সংখ্যা কমে যাওয়া নয়াদিল্লির জন্য দীর্ঘমেয়াদে কৌশলগত ক্ষতির কারণ হতে পারে।
ভারত যদি বাংলাদেশকে একটি শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে, তবে এটি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে আরও নাজুক করতে পারে। তবে, নয়াদিল্লি এখনও বাংলাদেশি সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে এই সম্পর্ককে নতুন করে গড়ে তুলতে পারে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের ভূমিকা ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। এই নতুন পরিস্থিতি নয়াদিল্লিকে তার কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে এবং বাংলাদেশের সাথে নতুন উপায়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে বাধ্য করবে।