শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন তীব্র হয়েছে। হাসিনা বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন, যা বাংলাদেশের ক্ষোভের অন্যতম কারণ। এদিকে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রতি তাঁর আহ্বান ভারতের জন্য বিস্ময়কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি ভারতকে হাসিনাকে চুপ রাখার আহ্বান জানান, যদি তাঁকে ভারতে থাকতে দেওয়া হয়।
ড. ইউনূসের এই বক্তব্যকে ভারতীয় কূটনীতিকরা ‘মেগাফোন কূটনীতি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। মেগাফোন কূটনীতি এমন এক ধরনের কূটনীতি যেখানে গণমাধ্যমের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জটিল ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। তবে, ভারত এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি, যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা ড. ইউনূসের এই বক্তব্যে ‘বিচলিত’।
ভারতের বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার ভারতে থাকা ও ড. ইউনূসের বক্তব্য দু’দেশের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে। হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তবে, ভারত তাকে রাখার সিদ্ধান্ত নিতে পারে যতদিন পর্যন্ত অন্য কোনো দেশ তাকে গ্রহণে প্রস্তুত না হয়। এদিকে, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের প্রধান প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার করা হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে ভারত আরও নিবিড় সম্পর্ক রাখতে চেষ্টা করছে। তবে ভারতীয় কূটনীতিকরা বিএনপির সাথে সংলাপের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চান।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে ৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখযোগ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার মানুষ এই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে, যার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যতের জন্য জনগণের উদ্বেগ ও মতামত প্রকাশিত হয়।
এই সমাবেশগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা হাসিনা সরকারের পতনের পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন এবং নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপগুলোর প্রতি সমর্থন ও সমালোচনা উভয়ই উঠে আসে। প্রধান শহরগুলোতে আয়োজিত এই সমাবেশে উপস্থিত মানুষের সংখ্যা বিপুল ছিল, এবং তাদের মধ্যে অনেকে সরকারের পরিবর্তনকে দেশের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখেন।
তবে সমাবেশগুলোতে নিরাপত্তা ছিল কড়া, এবং কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে ছিল।
ড. ইউনূসের পরবর্তী পদক্ষেপ:
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে তিনি এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে স্থিতিশীল করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারেন। তার কিছু সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারে:
–অন্তর্বর্তী সরকারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা: ড. ইউনূসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে সুষ্ঠুভাবে দেশের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করা। এতে জনগণের আস্থা অর্জন এবং দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
–নির্বাচনের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা: তিনি দেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। এর মাধ্যমে তিনি দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবেন।
–আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন: ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক বিবৃতি এবং কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ভারতসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা চালাতে পারেন। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্কের মীমাংসায় কূটনৈতিক আলোচনা ও সমঝোতা তৈরি করা তার জন্য একটি অগ্রাধিকার হতে পারে।
–অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তি: দেশের অভ্যন্তরে চলমান রাজনৈতিক সংকট ও সামাজিক অস্থিরতা নিরসনের জন্য বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা ও সমন্বয় সাধন তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হবে।
–অর্থনৈতিক পুনর্গঠন: দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য তিনি অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ নিতে পারেন।
–হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার প্রসঙ্গ: শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সম্ভাব্য কূটনৈতিক এবং আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি তার পরবর্তী পরিকল্পনার একটি অংশ হতে পারে। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম চালানো এবং সুষ্ঠু বিচারের মুখোমুখি করা।
ড. ইউনূসের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নির্ভর করবে দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনের ওপর, যেখানে তার নেতৃত্ব এবং কৌশল নির্ধারণী ভূমিকা পালন করবে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া:
ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তার ভূমিকা নিয়ে ভারত সরাসরি কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে কিছু নির্দিষ্ট সূত্রের মাধ্যমে ভারতের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়:
ড. ইউনূসের সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে মন্তব্য এবং ভারতকে তাকে (হাসিনাকে) চুপ থাকতে বলার আহ্বান ভারতকে কিছুটা অবাক করেছে। ভারতীয় কূটনৈতিক মহল এই ধরনের ‘মেগাফোন কূটনীতি’র (যেখানে গণমাধ্যমের মাধ্যমে কূটনৈতিক আলোচনা হয়) প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
ভারত এখনও পর্যন্ত ড. ইউনূসের মন্তব্যের বিষয়ে কোনো সরাসরি সরকারি প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ভারতীয় কর্মকর্তারা আভাস দিয়েছেন যে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনাবলীর ওপর নজর রাখছেন এবং যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে অপেক্ষা করছেন।
ড. ইউনূস যখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে নিম্ন পর্যায়ে বলে উল্লেখ করেছেন, তখন ভারতীয় বিশ্লেষকরা এবং সাবেক কূটনীতিকরা তার এই মন্তব্যে বিস্মিত হয়েছেন। তারা মনে করছেন, ড. ইউনূস হয়তো বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রকৃত অবস্থাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারেননি, বিশেষ করে শেখ হাসিনার শাসনামলে দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে।
ভারতীয় কূটনৈতিক মহল মনে করছে, শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে, যা ভারতের কৌশলগত এবং রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রভাবিত করবে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং বিভিন্ন পক্ষের মন্তব্যগুলো গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করছে।
ভারতের সাবেক কূটনীতিকরা উল্লেখ করেছেন যে, ভারত আন্তরিকভাবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে প্রস্তুত, তবে তারা এ ধরনের বিতর্কিত মন্তব্যের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছে না।