Thursday , November 14 2024
Breaking News
Home / Countrywide / টাকা দাও, বাকিটা দেখবো, আমি পুলিশের লোক, আমার দ্বারা সবই সম্ভব: এএসপি

টাকা দাও, বাকিটা দেখবো, আমি পুলিশের লোক, আমার দ্বারা সবই সম্ভব: এএসপি

বাংলাদেশের সরকারি কার্যালয়গুলোতে দুর্নীতির চিত্র দেখতে পাওয়া যায় এবং যেটা হারহামেশাই চলছে। সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকলেও তারা সেই সেবা বাদ দিয়ে কিভাবে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া যায় দুর্নীতি করা যায় সে বিষয়টি নিয়েও ব্যস্ত থাকেন। তার থেকে বাদ যান না প্রশাসনের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারাও। এবার পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিজের স্ত্রীর ছোট ভাই ও বোনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, তিনি তার শ্যালক এবং শ্যালিকার কাছ থেকে ওই টাকা নেন জমি ও ফ্ল্যাট কিনে দেওয়ার কথা বলে।
শুধু তাই নয়, খাগড়াছড়ি পার্বত্য অঞ্চলের মানিকছড়ি এলাকায় একই পাহাড় দুই জনের কাছে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। উপ-পরিদর্শক (এসআই) থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে পদোন্নতি পাওয়া এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ সদর দফতর তদন্ত করছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রয়েছে। শিগগিরই তাকে বরখাস্ত করা হতে পারে বলেও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।

অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার নাম এনামুল হক শোভা। তিনি সিলেটের লালবাজার এলাকায় বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ইউনিট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-৭-এ এএসপি হিসেবে কর্মরত আছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তাজুল ইসলাম মামুন ও তার বোন মর্জিনা বেগম এএসপি এনামুলের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি আইজিপি কমপ্লেন্ট সেলে অভিযোগ করেন। অভিযোগটি তদন্ত করে ২০ জুলাই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগকারী মর্জিনা আক্তার ও মামুন এএসপির স্ত্রীর ছোট বোন ও ভাই। এই দুই ব্যক্তি তাদের জমি, প্লট, ফ্ল্যাট, দোকান, নগদ টাকা ও ডলার আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

একই পাহাড় দুবার বিক্রি করে

এনামুল হক শোভা খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি থানায় এসআই পদে কর্মরত ছিলেন। এদিকে এনামুল হক আমেরিকায় অবস্থানরত তার শ্যালক তাজুল ইসলাম মামুনকে জানান, মানিকছড়িতে একটি জায়গা বিক্রি হবে। মামুন সেখানে গিয়ে দেখেন এটি একটি পাহাড়। মামুন তাকে বলেন, পাহাড় বিক্রি করা আইনত নিষিদ্ধ। পাহাড় বিক্রি কিভাবে? তখন এনামুল হক মামুনকে বলেন, ‘তুমি টাকা দাও, আমি বাকিটা দেখবো। আমি পুলিশের লোক। আমার দ্বারা সবই সম্ভব। তোমার লাভ পেলেই তো হলো।’

এরপর এনামুলকে আট লাখ টাকা দেন মামুন। মামুন জানান, ২০২০ সালে একই পাহাড় ৪০ লাখ টাকায় অন্য এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করেন এনামুল। তবে মামুন তার আট লাখ টাকা ফেরত দেননি। টাকা দিয়েও পাহাড় না পেয়ে ক্ষু’ব্ধ মামুন পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে লিখিত অভিযোগ করেন।

এএসপি এনামুল হকের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এখলাসপুর এলাকায়। অভিযোগকারীরা জানান, পুলিশে যোগদানের পর থেকে এনামুল ঢাকা, নোয়াখালী, সিলেট ও ​​বান্দরবানে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন। ঢাকায় তার প্লট, ফ্ল্যাট, নোয়াখালীতে একাধিক বাড়ি, বান্দরবানে পাহাড় ও বাগান রয়েছে।

প্রতারণার মাধ্যমে আত্মীয়স্বজনের জমি আত্মসাৎ

এনামুল হকের শ্যালিকা মর্জিনা আক্তার ঢাকার খিলগাঁওয়ে থাকেন। ভাই মামুনের পাশাপাশি তিনিও এনামুলের বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরে আইজিপির অভিযোগ সেলে অভিযোগ করেন। তারা অভিযোগে উল্লেখ করেন, এএসপি এনামুল হক তাদের বড় বোনের স্বামী। তারা তাকে অভিভাবক হিসেবে সম্মান করে। কিন্তু এনামুল হক সেই সুযোগ নিয়ে তাদের জমি ও টাকা আত্মসাৎ করেন। এভাবে অনিয়ম করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

মর্জিনা আক্তার ও তার ভাই অভিযোগে উল্লেখ করেছেন যে, এনামুল হক তাদেরকে ২০০৬ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদী হাউজিং লিমিটেডের একটি প্লট যৌথভাবে কেনার জন্য অনুরোধ করেন। মামুন ও মর্জিনা তার প্রস্তাবে রাজি হন। পরে তার কথা বিশ্বাস করে তারা একবার ২০ লাখ টাকা দেয়। পরে জমির বিষয়ে জানতে চাইলে এনামুল বলেন, কোম্পানি দলিল দিচ্ছে না। কোম্পানির জমি ক্রয়ের রশিদ দেখতে চাইলে তিনি নীরব থাকেন। এভাবে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের সন্দেহ হয়। পরে তারা মোহাম্মদপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, এনামুল হক ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে রেজিস্ট্রিকৃত ৬২৬৬ নম্বর দলিলের মাধ্যমে তিনজনের পরিবর্তে নিজের নামে জমি রেজিস্ট্রি করেছেন।

২০০৮ সালে, তাজুল ইসলাম খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকা, চৌধুরীপাড়া, খিলগাঁও-এর সি-ব্লক নং ৩৮৩/৩৮৪-এর দুটি এনামুলকে বুকিং দেন। মামুন এনামুলকে কিস্তি বাবদ ৫৬ লাখ টাকা এবং জরিমানা ও সার্ভিস চার্জ বাবদ ৭ লাখসহ ৬৩ লাখ টাকা দেন। কিন্তু এনামুল হক এখানেও প্রতারণার আশ্রয় নেন। এনামুল মামুনকে ১০৫০ বর্গফুটের অ্যাপার্টমেন্ট নম্বর ডি-৪০৪ বুঝিয়ে দেন। নিজের নামে আরেকটি ফ্ল্যাট পেয়েছেন এনামুল। কিস্তি পরিশোধ করেও ফ্ল্যাট না পাওয়ার বিষয়ে মামুন এনামুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোম্পানি ফ্ল্যাট দেবে। পুলিশ অফিসার হওয়ায় ওই ফ্ল্যাটও দেবেন। কিন্তু এখনও ফ্ল্যাটের বাকি টাকা বা তার দেওয়া টাকা ফেরত দেননি ওই কর্মকর্তা।

মামুনের অভিযোগ, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় দোকান দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেন এনামুল হক। আজও ওই দোকানের কোনো পদ বা দলিল মামুনকে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া ঢাকার রামপুরার মেরুল বাড্ডা এলাকায় চারটি দোকান কেনার বিনিময়ে নেন ১২ লাখ টাকা। দোকানের কাগজপত্র বুঝিয়ে না দেওয়ায় এবং নানা যুক্তি দেখিয়ে মামুন গোপনে জানতে পারেন সেখানে কোনো মার্কেট বা দোকান নেই। মূলত ওই জায়গাটি ছিল সরকারি খাস জমি।

এনামুল মামুনকে চা বাগান কেনার প্রস্তাব দেন এবং দাবি করেন যে, তার কর্মস্থল সিলেটে হওয়ায় সেখানে কিছু লোকের সাথে তার পরিচয় হয়েছে। এভাবে তিনি মামুনের কাছ থেকে ২০ হাজার ডলার আত্মসাৎ করেন। মামুনের কাছে এ সংক্রান্ত কাগজপত্র রয়েছে।

ছেলেমেয়েরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছে

এনামুল হকের পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছেন। মর্জিনা ও মামুন আরও দাবি করেন, সেখানে টিউশন ফি, থাকা-খাওয়ার যাবতীয় খরচ এনামুল হক বহন করেন। তারা জানান, এনামুল হক নিজেও পরিবার নিয়ে কয়েকবার আমেরিকায় গেছেন। দুই ছেলের বিদেশে পড়াশোনার খরচের বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন এনামুল হক নিজেই।

নোয়াখালীতে একাধিক বাড়ি, প্লট, ঢাকায় ফ্ল্যাট

নোয়াখালীতে বাবার বাড়ির বাইরে সুসজ্জিত বাড়ি বানিয়েছেন এনামুল হক। কিন্তু পরিবার সেখানে থাকে না। ঢাকার ফার্মগেট আলরাজি হাসপাতালের পাশের একটি ভবনে ফ্ল্যাট, মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ে বাড়ি, বসিলায় প্লটের তথ্য পাওয়া যায়।

অভিযুক্ত এনামুল হকের বক্তব্য

এসব বিষয়ে জানতে শুক্রবার (৩০ সেপ্টেম্বর) ফোনে এনামুল হকের সঙ্গে কথা বলেন সংবাদ মাধ্যমের এক প্রতিবেদক। তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

এনামুল হক বলেন, “বর্তমানে বান্দরবানে আমার নামে কোনো পাহাড় নেই। এগুলো আমার বিরুদ্ধে ষ”ড়যন্ত্র। যারা অভিযোগ করেছে, আমি তাদের আমেরিকায় পাঠিয়েছি, আমি তাদের মানুষ বানিয়েছি। তারা এখন আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।

এনামুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করেন সিলেট আর্মড পুলিশ-৭ সদর দফতরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (টু-আইসি) দোলন মিয়া। চলতি বছরের ২০ জুলাই পুলিশ সদর দফতরে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তদন্তে একাধিক অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে এপিবিএন-৭ এর অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি খোন্দকার ফরিদুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “আমি এখানে যোগ দিয়েছি মাত্র এক মাস হলো। ঘটনা তার আগের। আমি আসলে বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানি না।”

তবে এই ধরনের দুর্নীতি ছাড়াও ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আরো নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে, যেগুলো তিনি প্রশাসনিক কর্মকান্ডের মাঝেই করে থাকেন, বলে জানা গেছে। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কিনা সে বিষয়ে কোন কিছু স্পষ্ট জানায়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। তবে আইজিপির নিকট তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপে যেতে পারে প্রশাসন এমনটিই জানা গেছে। তবে তার দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে চাকরি থেকে দরখাস্ত করতে হবে বরখাস্ত করা হতে পারে।

About bisso Jit

Check Also

উপদেষ্টা পরিষদেই বৈষম্য

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে আঞ্চলিক বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে। ২৪ সদস্যের এই পরিষদে ১৩ জনই চট্টগ্রাম …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *