ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থ সংকট কাটছে না। ব্যাংকগুলো তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সবসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছে। মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা কমাতে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে। ব্যাংকাররা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সহযোগিতার কারণে ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার হাত থেকে রক্ষা পেলেও স্থায়ী কোনো সমাধান হচ্ছে না। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে পারলে এবং খেলাপিদের টাকা ফেরত দিলে এ সংকট অনেকাংশে নিরসন হতো।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পাওয়ার শর্তে প্রতিদিনের পরিবর্তে সপ্তাহে দুই দিন টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তহবিল ব্যবস্থাপনা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেয়ার পরের দিনই ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিতে আনেন। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপকরা তাদের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল দৈনিক ভিত্তিতে আর তহবিল জোগান দেয়া হবে না।
তবে, এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, জরুরী প্রয়োজনে ব্যাংক ও অর্থ সংস্থাগুলিকে তারল্য প্রদানের জন্য বিদ্যমান তাত্ক্ষণিক ঋণ সুবিধা এবং তাত্ক্ষণিক আমানত সুবিধা আগের মতোই প্রতিদিন অব্যাহত থাকবে। এসব উপকরণ ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ ও আমানত সুবিধা নিতে পারবে। এ বিষয়ে গত সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
একইসঙ্গে বছরের শেষ দিনে তারল্য সংকট মেটাতে ব্যাপক চাপে রয়েছে ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে ১৫ দিনের পরে, ব্যাঙ্কগুলিকে বাধ্যতামূলক নগদ জমা অনুপাত (CRR) বজায় রাখতে হবে। কিন্তু অর্থ সংকটে ওই দিন শেষে অধিকাংশ ব্যাংকে সিআরআর ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে।
এ অবস্থায় ওই দিন ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা বিভিন্ন উপকরণ বন্ধক রেখে টাকার চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন সিদ্ধান্তে অনেক ব্যাংকই বছরের শেষ দিনে সিআরআর ঘাটতি হওয়া থেকে রক্ষা পায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থবছর শেষ হওয়ার আগের দুই কার্যদিবস ছিল ২৭ জুন বৃহস্পতিবার ও ৩০ জুন রোববার। ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ১৬ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা ধার দেয়। আর গত বৃহস্পতিবার ধার দেয়া হয় ১৫ হাজার ৫১ কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ দুই কার্যদিবসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে ধার দেয়া হয় ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা জানান, বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকগুলোতে নগদ অর্থের সংকট রয়েছে। কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপক ব্যাংক থেকে বেনামে ঋণ নিচ্ছেন। কিন্তু এসব ঋণের অধিকাংশই পরিশোধ করা হচ্ছে না।আবার বিভিন্ন সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিসহায়তার মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা ছাড় পেয়ে যান। যেমন, কখনো নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে, আবার কখনো সুদহারে ছাড় পেয়ে ঋণ পরিশোধ না করেই ঋণ নবায়ন করেন। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর নগদ আদায় তুলনামূলকভাবে কমে গেছে। বিপরীতভাবে প্রতিটি পণ্যের দাম দ্বিগুণ তিনগুণ হয়েছে। কিন্তু এ অনুযায়ী আয় বাড়েনি। বাধ্য হয়ে মানুষ তার ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যাংকের জমানো টাকা তুলে নিচ্ছেন। এসব কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় টান পড়ে। বাধ্য হয়ে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলো প্রায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ ধার করে চলছে।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, অর্থবছরের শেষ কয়েক দিনে গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে আমানত তুলে নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। অনেক গ্রাহক জুন মাসে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার সুবিধার জন্য ব্যাংকারদের অনুরোধ রক্ষা করেছেন। কিন্তু জুন শেষে কার্যদিবস থেকে অর্থাৎ ২ জুলাই থেকে আবারও আমানত উত্তোলনের চাপ বেড়েছে। এখন অনেক মামলা মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এই কর্মকর্তা আক্ষেপ করে বলেন, যারা ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছেন তারা যদি কিছু টাকা ফেরত দিতেন তাহলে তাদের এই সংকটের সম্মুখীন হতে হতো না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, গত রোববারের সিদ্ধান্তের প্রভাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারকদের নজরে আনা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরদিন সোমবার এক বিজ্ঞপ্তির ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, জরুরি ভিত্তিতে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোকে তারল্য প্রদানের জন্য তাৎক্ষণিক ঋণ সুবিধা ও তাৎক্ষণিক জমা সুবিধা- দুটি উপকরণ ইতিমধ্যে চালু রয়েছে।
এর নিলামও প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে এর ব্যবহার কম হতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এ দুটি উপকরণ ব্যবহার করে তারল্যের জোগান কম দিত। এখন আইএমএফের শর্তের কারণে রেপো সুবিধা কমাতে হয়েছে। যার কারণে তাত্ক্ষণিক ঋণ সুবিধা এবং তাত্ক্ষণিক আমানত সুবিধা উভয়ই এখন পুনরায় সক্রিয় করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তারল্য সুবিধা নিতে ব্যাংকগুলি প্রতিদিন এই উপকরণগুলি ব্যবহার করতে পারে।