আ.লীগের উপদেষ্টা পরিষদের মেম্বর ও সাবেক এমপি জয়নাল হাজারী গতকাল শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃ’ত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। সোমবার বিকেল ৫টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তিনি সবাইকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন। গত কয়েকদিন ধরে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সোহরাবুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। জয়নাল হাজারীর প্রয়ানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ক্ষমতাসীন দল আ.লীগের অনেক নেতা-মন্ত্রী গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে হৃদরোগ, কিডনি ও ফুসফুসের সমস্যাসহ বেশ কয়েকটি জটিল রোগে ভুগছিলেন। প্রাক্তন এই এমপি দীর্ঘদিন ফেনী জেলার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ফেনী-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে ৪ বার নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক জীবনের পুরো সময় আলোচনা-সমালোচনায় ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন হাজারী। জেলা পর্যায়ের নেতা হয়েও এক সময় জাতীয় রাজনীতিতে আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু দল ক্ষমতায় থাকলেও গত ১০ বছর রাজনৈতিকভাবে ছিলেন অনেকটা ‘নিঃস্ব’।
জয়নাল হাজারী ১৯৪৫ সালের ২৪ আগস্ট ফেনী শহরের সহদেবপুরের হাবিবুল্লাহ পণ্ডিতের বাড়িতে জন্ম নেন। তারা বাবা আব্দুল গণি হাজারী ও মা রিজিয়া বেগম। সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকালে রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন।
ছাত্রাবস্থায় ফেনী কলেজে তৎকালীন ছাত্র মজলিশের (বর্তমান ছাত্র সংসদ) জিএস ছিলেন। এরপর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। পরে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদেও দায়িত্ব পালন করেন জয়নাল হাজারী।
সংসদ সদস্য হিসেবে শেষ মেয়াদে নানা বিতর্কে জড়ান জয়নাল হাজারী
১৯৭১ সালে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের পরামর্শে রাজনগর এলাকায় সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন জয়নাল হাজারী। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযু’দ্ধে অংশ নেওয়ার পর রাজনগরে যান। ওই এলাকার বেকার যুবকদের নিয়ে একটি সিভিল ডিফেন্স টিম গঠন করেন।
১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ফেনী-২ (সদর) আসন থেকে ১৯৮৬, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে টানা তিন বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯৬-২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন ফেনীতে রাজনৈতিক সন্ত্রা’সের শি’কার হয়ে প্রায় ১২০ জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মী মা’রা যান। এই পেক্ষাপটের পেছনে হাজারীকে সন্দেহ করা হয়। ২০০১ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ১৬ আগস্ট রাতে তার বাসভবনে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। ১৭ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান জয়নাল হাজারী।
সংসদ সদস্য হিসেবে শেষ মেয়াদে নানা বিতর্কে জড়ান জয়নাল হাজারী। এ কারণে ২০০৪ সালে দল থেকে বহিষ্কার হন। এরপর দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় ছিলেন। ফেনী থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক হাজারিকা’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তিনি।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফেরেন। পাঁচটি মামলায় ৬০ বছরের সাজা হয় তার। এরপর ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করলে আট সপ্তাহের জামিন পান। পরে ১৫ এপ্রিল নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে পাঠানো হয় কা’রাগারে। চার মাস কারাভোগের পরে ২০০৯ সালের ২ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্ত হন।
আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার দেড় দশক পর দলীয় পদে ফেরেন জয়নাল হাজারী। ২০১৯ সালে ফেনীর এই নেতাকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাকে এই পদে মনোনয়ন দেন। এর আগে হাজারীর চিকিৎসার জন্য একই বছরের সেপ্টেম্বরে ৪০ লাখ টাকা অনুদান দেন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ সংসদ সদস্য থাকাকালে তিনি ও তার বা’হিনীর কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়। তিনি আওয়ামী লীগের বাইরে ‘স্টিয়ারিং কমিটি’ নামে একটি নিজস্ব বাহি’নী গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ ওঠে।
তবে হাজারীর দাবি ছিল, ‘স্টিয়ারিং কমিটি মানুষের জন্য কাজ করেছে। তারা ভালো কাজ করেছে। আমার প্রধান শত্রু জামায়াত-শিবির। তাদের সঙ্গে লড়াই করে আমাকে বাঁচতে হয়েছে। তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে। এর বাইরে আমার আর কিছু জানা নেই। যারা আমাকে বিতর্কিত বলে তারাই বলতে পারবে কেন বলে।’
দেশের আলোচিত বিভিন্ন ইস্যুতে মন্তব্য করে আলোচনায় আসতেন তিনি। আলোচিত পরিমণিকাণ্ড ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আব্দুল কাদের মির্জার ‘সত্যবচন’ নিয়েও কথা বলেছিলেন।
জয়নাল হাজারী প্রিন্সেস ডায়নার মৃ’/ত্যু নিয়ে গণমাধ্যমের বাড়াবাড়ি, মানুষের অযাচিত কান্না ও শেষকৃত্যে জনতার ঢল এবং মাদার তেরেসার মৃ’ত্যুকে উপেক্ষা করার ঘটনা নিয়েও কথা বলেন।
হাজারী আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, ‘মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়ে মারা যাওয়া ডায়নাকে নিয়ে এত কিছু হলো, যদিও তার দুই দিন পরই মাদার তেরেসার মৃ’ত্যু হয়। কিন্তু তেরেসাকে নিয়ে সেই অর্থে মানুষেরা বা গণমাধ্যম তেমন আগ্রহ দেখায়নি। তার শেষকৃত্যে এক হাজার মানুষও উপস্থিত হয়নি এবং গণমাধ্যমেও তেমন খবর আসেনি। এই হলো পৃথিবী।’
‘চিরকুমার’ ছিলেন জয়নাল হাজারী
ব্যক্তিগত জীবনে ‘চিরকুমার’ ছিলেন জয়নাল হাজারী। কলেজজীবনে প্রেমিকা বিজুকে হারিয়ে তার বিরহে আর বিয়ে করেননি বলে দাবি করেছিলেন তিনি।
জয়নাল হাজারী বেশ কিছুদিন পূর্বে দেশের একটি টিভি চ্যানেলে তার সাক্ষাৎকারে তিনি তার সেই সময়কার ঘটনা স্মরণ করে বলেন, সেই সময় বিজুও ছিলেন কলেজের ছাত্রী। আমাদের দুজনের মাঝে চমৎকার সম্পর্ক ছিল আমি গান রচনা করতাম, আর সেই গান গাইতো বিজু । এই ভাবেই আমরা দুজন দুজনার কাছাকাছি আসি। পরবর্তীতে আমরা প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি যখন দেশ স্বাধীন করার জন্য চলে যাই, সেই সময় তারা সোনাগাজী এলাকাতে নিজেদের লুকিয়ে রাখে।
পরবর্তীতে এক রাজাকার তার সাথে জোর করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করে। বিজুর সেই সময় আমাকে জানিয়েছিল সে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না। যাই হোক, যুদ্ধ চলাকালীন খবর পেলাম সে বিয়ে করেছে। আমি যদি চাইতাম তাহলে তাকে আমার সাথে বিয়ে করতে বাধ্য করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা না করে তার জীবন নিয়ে ভেবেছি। বিজু আমাকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। এ কারণে আমি সেই সময় বিচার চেয়েছিলাম। এরপরে আমার জীবনে আর সঙ্গী হিসেবে কাউকে চাইনি।