বাংলাদেশের সাবেক অনেক সেনা কর্মকর্তারা এখন বিদেশে অবস্থান করছে। অনেকেই একটা সময়ে দেশের হয়ে কাজ করছেন নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে। এরপর তারা পারি জমিয়েছেন বিদেশে। সেখানে বসেই দেশের নানা ধরনের বিষয় নিয়ে কথা বলে থাকেন তারা। তাদের মধ্যে একজন হলেন মোস্তাফিজুর রহমান। সম্প্রতি তিনি তার ধারাবাহিক একটি লেখার নতুন পর্ব ছেড়েছেন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে টা তুলে ধরা হলো হুবহু :-
বাংলাদেশের একজন নাগরিক এবং মানবতার সদস্য হিসাবে আপনার কর্তব্যের বিপরীতে আপনি কীভাবে আপনার পরিবার বা বন্ধুবান্ধবের উপর ব্যক্তিগত আনুগত্যের ভারসাম্য বজায় রাখেন? আপনার সেই আনুগত্যের গ্রাফটি কেমন বলুন তো! এখানে প্রতিটি ব্যক্তির নিজের গাট ইন্সটিংট (gut instinct) এর উপর ভিত্তি করে সেই লাইনটি নির্ধারণ করা কি ঠিক? নাকি লাইনটিকে দেখতে কেমন হবে তার একটি অবজেক্টিভ নৈতিক উপায় আছে?
আমি এই দ্বিধা দ্বন্দে ছিলাম অনেকদিন। বিশেষত: ১ প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন থেকে দেড় বছরের মাথায় আমাকে সুদানে (৩য় বারের মত ইউএন মিশন) একটি কমান্ডো ইউনিটের অধিনায়ক হিসাবে পাঠিয়ে দেয়া হল তখন এই দ্বন্দ্ব ছিল প্রকট। সেখানে অধিনায়ক হিসাবে আমার কাজ দেশে আমার কাজের তুলনায় অনেক কম ছিল। সব কাজ ছিল ফরমেটেড এবং আমার স্টাফ অফিসাররাই বেশীরভাগ কাজ সেরে ফেলতেন। মিশনে থাকাকালীন এই অবকাশে সেনাবাহিনীর পরিবর্তনগুলো এবং আমার নিজের চোখে দেখা অনিয়মগুলো বিস্তারিত মূল্যায়ণ করার সময় হলো।
শুরুতেই বলি, নিজের কর্মক্ষেত্র কিংবা নিজের গোত্রের অন্যায়, অনাচার, অধর্ম, অবিচার কিংবা অসততার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবার মত নৈতিক সাহস এবং মানসিকতা তৈরী একটি কঠিন প্রক্রিয়া। সেনাবাহিনীতে একজন আপরাইট অফিসার হিসাবে আমার আইনী অধিকার আছে আমাকে কোন বেআইনী কাজে নিয়োজিত করলে তা থেকে নিজেকে এবং নিজের অধিনস্তদের বিরত রাখা। আমার সামনে কোন অনিয়ম হলে সেটা আমি বাঁধা দেবার ক্ষমতা রাখি কিন্তু গুম/খুন সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর দোষী ব্যক্তি নিজেকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে সব সময় এর একটি আইনি ঢাল প্রস্তুত রাখে। তবে আমার কাছে সবার আগে দেশ, যা আমাকে এই লিখা লিখিতে অনুপ্রনীত করেছে।
জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া সেনাপ্রধান থাকাকালীন সময়ে প্রথম আমি অফিসারদের মধ্যে র্যাবের ক্রসফায়ার/লে: কর্নেল জিয়া র্যাব যে সব অফিসার প্রেষনে যাচ্ছে তাদের খু’নী বানাচ্ছে এসব কথা প্রকাশ্যই আলোচনা হতে শুনি। এর কারণ জেনারেল করিম জিয়ার অনৈতিক কর্মকান্ড বিষয়ে কথা বলেছেন মর্মে এএসইউ এর ইন্টালিজেন্স ব্রিফিং এ একদিন এই প্রসংগটি উঠেছিল এবং এই তথ্যটা পরবর্তিতে সাধারণ অফিসারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় জিয়া উপর কিছুদিন সেনানিবাসে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল যা পরবর্তিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা রহিত হয়। সে সময় যেসব অফিসার র্যাবে পোস্টিং পেতেন এবং র্যাব থেকে সেনাবাহিনীতে ফেরত আসতেন জেনারেল ইকবাল করিম নিজে সবার ইন্টারভিউ নিতেন।
জিয়াউল আহসান র্যাব এ থাকাকালীন সময়ে ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা/গুম খুনের কথা আমি কাছের দূরের অফিসারদের মুখে শুনছিলাম অনেকদিন ধরেই। অন্যের মুখে ঝাল খাওয়ার অভ্যাস আমার না থাকলেও একদা রুমমেট এবং নিকট বন্ধুর নামে এসব শোনা ছিল আমার জন্য অস্বস্তিদায়ক। মূল ঘটনায় আসি এবারে। ২০১০ সালে আমি ছিলাম অধিনায়ক এএসইউ, ঢাকা। তখন ঢাকা সেনানিবাসের স্টাফ রোড এর মাথায় এয়ারপোর্ট রোডের উল্টোদিকে প্রায়শই ছিনতাই হতো। আমার ফিল্ড স্টাফ বা আর্মি এমপি এইদিকে টহল বৃদ্ধি এমনকি আমার কোভার্টলি এএসইউ মোতায়নও এই ছিনতাই বন্ধ করতে পারছিলনা। একদিন তৎকালীন ডিএমআই (ডিরেক্টর মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) আমার সামনেই এক অনুষ্ঠানে জিয়াকে বললেন, ‘জিয়া দেখোতো এই স্টাফ রোড এলাকায় ছিনতাইটা বন্ধ করতে পার কিনা’। কিছুদিন পর জিয়া আমাকে জানালো যে, (২১ অক্টোবর ২০১০) সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে স্টাফ রোড এলাকায় একটা অপারেশন হবে। আমি সাথে সাথে ডিএমআইকে জানালাম। সেই সময়টায় এএসইউ এর কোন অধিনায়ক পোস্টিং না হওয়ায় আমি সরাসরি ডিএমআই এর কাছে রিপোর্ট দিতাম।
মাগরিবের নামাজের কিছুক্ষণ পর ওয়ারলেস সেটে জানতে পারলাম যে, স্টাফ রোডের অপরদিকে নির্মানাধীন ওভারব্রিজের নীচ থেকে একটা গুলির শব্দ হয়েছে। আমি বুঝতে পারলাম এটা নিশ্চয়ই জিয়ার সেই অপারেশন! ঘটনা জানার জন্য আমি জিয়াকে ফোন করলে সে জানালো যে, স্টাফ রোড়ের উল্টোদিকে র্যাব ইন্টেলিজেন্সের দুইজন সদস্য যখন ছদ্মবেশে যাচ্ছিল তখন তাদের ছিনতাই করার চেষ্টা করলে ছিনতাইকারী গুলিবিদ্ধ হয়। আমি সাথে সাথে স্পটে যাওয়ার পথে দেখলাম যেখানে ছিনতাই হয়েছে বলা হচ্ছে সেটা রাস্তার উল্টো দিকে আর ছিনতাইকারীর লা’শ ‘নির্জন ফ্লাইওভারের নীচে পড়ে আছে। লা’শে’র’ পাশে একটি দেশী পি”স্তল’ আর দুই রাউন্ড কার্তুজ। আমি প্রথম দেখাতেই বুঝে গেলাম যদি ছিনতাই হয়ে থাকে তবে সেটা এই ওভারব্রিজের নীচে হয়নি আর ছিনতাইকারীকে এই নির্জন স্থানে নিয়ে এসে র্যাব সদস্যরা গু’লি করেছে এটাও অবাস্তব। হঠাৎ অংকটা মিলে গেল যেন! জিয়া যখন বলেছিল আজ একটা অপারেশন হবে তখনই এই ছিনতাইকারী র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। তারপর র্যাব তাকে এই নির্জন স্থানে এনে সরাসরি হত্যা করেছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে স্বয়ং ডিএমআই এলেন এবং একটু পরে জিয়াও চলে এলো স্পটে। ডিএমআই এর উপস্থিতিতে তৎকালীন করিৎকর্মা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জিয়াউল আহসান সুন্দর একটা ব্রিফিং দিল কীভাবে ছিনতাইকারী অস্ত্র বের করার সাথে সাথে র্যাব সদস্যরা তাকে ওয়েস্টার্ন মুভির মত ফাস্ট ড্র করে তাকে হত্যা করল। আমি অধিনায়ক এএসইউ ঢাকাডেট থাকাকালীন পুরো সময়টাই জিয়ার সাথে ক্লোজলি কাজ করেছি এবং নানা ঘটনার স্বাক্ষী।
২০১৪ সালের জুলাই মাসে আমি মিশন শেষে দেশে ফেরত এলাম। মিশন পরবর্তী ইউনিট এএসইউ’তে যোগদান করার আগে ছুটি কাটাচ্ছিলাম। এর মধ্যে ঢাকায় পোস্টেড আছে এমন কোর্সমেটদের আমাদের বাসায় ডিনারের দাওয়াত করলেও জিয়া এবং আমার আরেক কোর্সমেট তৎকালীন কর্নেল মাহবুবকে (বর্তমানে ডিএ ইউকে) বাদ রাখলাম। এর কারণ সরল: জিয়া আর মাহবুব দু’জনেই যেহেতু ক্ষমতাসীন সরকারের অতি কাছের মানুষ তাই তারা তখন থেকেই তাদের সমমনাদের সার্কেল মেইনটেইন করতো। আমি যেহেতু তাদের দলভুক্ত নই তাই আমার সাথে তাদের প্রয়োজন মোতাবেক সম্পর্ক রাখা শুরু করলো যা আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম। নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে হৈচৈ করে বন্ধুরা এলো এবং তারা আমাকে অনুরোধ করলো জিয়া আর মাহবুবকে কল দেবার জন্য। আমি কোর্সমেটদের বললাম, দোস্ত আমি কারো প্রয়োজনের বন্ধু হতে চাইনা। যাহোক, শেষ পর্যন্ত বন্ধুদের পিড়াপিড়িতে তাদের দাওয়াত দিলাম। ৩০ মিনিটের মধ্যেই জিয়া আর মাহবুব হাজির হয়ে গেল আমাদের বাসায়। ওরা যেন রেডি হয়েইছিল।
মনের ভাব চেপে বাড়ির গেটে আমি ওদের স্বাগত জানালাম। তারাও এমন ভাব করল যে বন্ধুকে অনেকদিন পর দেখে যারপরনাই খুশী। এদিকে আমার অভিনয়ও মন্দ হলো না। খাওয়াদাওয়া শেষে আমাকে খাতিরের রহস্য উন্মোচিত হল।
২০১৪ সালে তখনও জিয়া এবং মাহবুব আজকের মত এত শক্তিশালী না হয়ে উঠলেও তাদের পাওয়ার প্লে অব্যাহত ছিল। জিয়ার গুম খু’ন এবং সেনা সদস্যদের অনৈতিক/হত্যাকান্ডে জড়িত করা এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সেনাবাহিনী/সেনাপ্রধানের কোন ফাইল সেখানে গেলে আশানুরূপ গুরুত্ব না দেয়া কিংবা একমত না হওয়ার মত নোট লিখার জন্য এই দুইজন তখন তৎকালীন সেনাপ্রধান ইকবাল করিম স্যারের বিরাগভাজন ছিল। তারা চায় আমি যেন এএসইউতে জয়েন করে সেখানে তাদের বিরুদ্ধে/গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকলে তাদের সাথে শেয়ার করি। এ বিষয়ে দেখলাম অন্য কয়েকজন কোর্সমেটও কঠোর ভাবে একমত। আমি মূলত: আমার বাসায় দাওয়াত দিয়ে বন্ধুদের এই প্রস্তাবের সাথে একমত নই সেটা বলতে পারিনি। আমি বরাবরই স্ট্রেইট সোলজার হলেও এখানে ডিপ্লোমেসির সাহায্য নিই। আমার কপাল ভাল, কমান্ডেন্ট এএসইউ আমাকে অধিনায়ক ডেট এএসইউ সিলেটে পোস্টিং করে দিলেন। আমার ধারণা, আমি জিয়া আর মাহবুবের কোর্সমেট হওয়ায় তিনি আমাকে আর ঢাকায় রাখেননি।
আমাকে এএসইউতে জয়েন করার আগে বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে সেনানিবাসে যাতায়াত করতে হতো। এ সময় আমার সাথে ডিজিএফআই এর একজন অফিসারের সাথে কথা হল স্টেশন হেডকোয়ার্টারে। সেই অফিসার কোন এক সূত্র থেকে জেনেছে যে, আমি কোর্সমেটদের বাসায় দাওয়াত দিয়েছি কিন্তু জিয়া আর মাহবুবকে বাদ দিয়ে। কথা প্রসংগে জানা গেলো, ডিজিএফআই এর কিছু অফিসার জিয়াকে অপছন্দ করে নানা কারণে। তার অন্যতম কারণ হলো: জিয়ার এ্যাটিচুড, ওভার কনফিডেন্স আর ডিজিএফআই এর উপর মহলে খাতির রাখা তবে নিম্ন পদবীর অফিসারদের অবজ্ঞার চোখে দেখা। তবে তাদের মূল ক্ষোভ ছিল ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে ডিজিএফআই এর মত সংস্থাকে না জানিয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কী ইলিয়াস আলীর গুমের ঘটনা বলছো? সে বলল জ্বী স্যার। তারপর সে আমাকে জানালো এ বিষয়ে যখন ডিজিএফআই এর কোন ক্লু ছিলনা তখন তারা একটি ফরমাল তদন্ত করে। সেই রিপোর্টটা তার শাখায় আছে। আমি যথারীতি রিপোর্টটা দেখতে চাইলে সে ভয় পেয়ে বলল, স্যার আমি যদি এই রিপোর্ট আপনাকে দেখাই আর সেই ঘটনা যদি জিয়া স্যার জানে তবে ‘আই এ্যাম এ ডেড ম্যান’।
আমি জিয়ার ক্ষমতার গভীরতা বুঝতে পেরে তাকে বললাম, থাক তোমার কোন ক্ষতি হোক আমি তা চাইনা। তুমি কী আমাকে রিপোর্টটা শুধু একবার দেখাতে পারো? সে বললো, না স্যার এটা আনা যাবে না। আপনাকে আমার অফিসে নিয়ে গেলে কেউ না কেউ দেখবে, সেটাও চাইনা। যা হোক, আমি রিপোর্ট দেখার আশা ছেড়ে দিয়ে সিলেট যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। সন্ধ্যার দিকে যখন লাগেজ গুছাচ্ছি তখন বাসার দাড়োয়ান একটা বড় খয়েরী রঙের মুখবন্ধ খাম দিয়ে বলল, একজন লোক এসে এই খামটা আপনাকে দিতে বলেছে। আমি বললাম, তুমি তাকে বসতে বললা না? না স্যার, উনি খামটা দিয়ে বললেন এটা যেন আপনাকে দিই। তারপর দ্রুত চলে গেলেন সেই লোক।
আমি খাম খুলে দেখি জ্যাকপট!
সত্য সমাগত, মিথ্যা বিতাড়িত
প্রসঙ্গত, মোস্তাফিজুর রহমান একটা সময়ে ছিলেন সেনাবাহিনীর সব চৌকস একজন কর্মকর্তা। তিনি পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদকও। তবে তাকে ছাড়তে হয় সেই পদ। আর সেই থেকেই তিনি স্থায়ীভাবে বিশ্বাস করে যাচ্ছেন বিদেশের মাটিতে।